বইমেলা? দেখি, যাব একদিন। মাত্র তো শুরু হলো। এক মাস হাতে আছে। যাওয়া যাবে। হ্যাঁ, কারও কারও ভাবনাটা এরকম। তবে বইমেলার আলোচনায় এই মানুষগুলো মুখ্য নয়। বই বা বইমেলার সঙ্গে আরেকটি অংশের আছে নিবিড় সম্পর্ক, তারাই মূল সৌন্দর্য। তারাই মেলার প্রাণ। এই অংশটি নিজেদের সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতিগুলোকে বই এবং বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন।
প্রথম দিনের মতো অমর একুশে বইমেলার দ্বিতীয় দিনেও সরব উপস্থিতি ছিল তাদের। এর পাশাপাশি শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় ‘বেড়াতে যাই, চলো’ টাইপের মানুষেরা এসেছিলেন। বিপুল সংখ্যায় এসেছিলেন, বলতে হবে। প্রথম শিশু প্রহর হওয়ায় এসেছিল শিশুরাও। সব মিলিয়ে আগেভাগেই জমজমাট এক বইমেলার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে।
এদিন শিশুপ্রহর উপলক্ষে বেলা ১১টায় খুলে দেওয়া হয় প্রবেশদ্বার। তখন থেকেই আসতে শুরু করে খুদে পাঠকরা। বাবা–মায়ের হাত ধরে মেলায় ঢুকতে দেখা যায় তাদের। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বর ছিল প্রথম গন্তব্য। এখানে বইয়ের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটায় ছোট ছোট ছেলে–মেয়েরা। রঙিন প্রচ্ছদ, ‘ছবিওয়ালা’ বই নিয়ে ছিল বিশেষ আগ্রহ। তবে অদ্ভুত ঘটনাও চোখে পড়েছে। দেখা গেছে, বাচ্চা পছন্দের বই দেখে সেদিকে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু বাবা–মা কিনে দেওয়ার অত তাগিদ বোধ করছেন না। সবাই নন, দু একজন এমন বিচিত্র কা– করছেন।
বড়রা মেলায় এসেছিলেন বিকেল নাগাদ। অবশ্য ‘বড়রা’ না বলে ‘বিভিন্ন বয়সী’ বলাই ভালো। আর মাতিয়ে রেখেছিলেন বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে আসা তরুণ তরুণীরা। বন্ধুদের টিএসসির আড্ডাও স্থানান্তরিত হয়েছিল মেলা প্রাঙ্গণে। লক্ষ্য করে দেখা গেছে, মেলায় আসা মানুষজনের বেশিরভাগই গল্প আড্ডার কোনো না কোনো পর্যায়ে বইয়ের কাছে গেছেন। বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখেছেন। কিনেছেনও।
অন্যান্য বছরের মতো চলছে ফটোসেশন। বই কিনছেন না, বইয়ের নামটা ভালো করে দেখছেন না। কিন্তু বই হাতে ছবি তুলছেন। ফেসবুকে সে ছবি দিয়ে বলার চেষ্টা করছেন, আমি মেলায় এসেছি, আমি কিন্তু বই পড়ি! এই দৃশ্য কিছু সময় দেখতে মন্দ লাগে না। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা সব স্টলে এই এক ছবি কত দেখা যায়? লেখক প্রকাশকদের অনেকে তাই বিরক্ত।
বিরক্তি প্রসঙ্গে আর যে কথা না বললেই নয় সেটি বইমেলার আয়োজকদের বিরুদ্ধে যাবে। এবার মেলা আয়োজন ও পরিচালনার সব কাজ বাংলা একাডেমি করছে। কিন্তু আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য এতে যোগ করতে পারেনি তারা। পুরনো মেলার লেআউট এদিক ওদিক করে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবস্থাপনাও দুর্বল। দ্বিতীয় দিনে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢুকে শুনতে হয়েছে হাতুড়ির ঠুকঠাক শব্দ। কোথাও হাতুড়ি। কোথাও চলছিল করাত। আগের রাতের বৃষ্টির কারণে কড়ইতলায় কাঁদা জমে গিয়েছিল।
তার চেয়েও বেশি বিরক্ত হতে হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রবেশের সময়। এখানে মূল মেলা। অসংখ্য মানুষ প্রবেশ করছিল। কিন্তু প্রবেশের সময় দেখা গেল, আর্চওয়ে কাজ করছে না। এমনকি কোনো পুলিশ সদস্য নেই। ভেতরে বসে গল্প করছিলেন তারা। ফলে মানুষজন যে যার মতো করে মেলায় ঢুকছিলেন। বের হচ্ছিলেন। এভাবে চললে নিরাপত্তার হুমকিতে পড়তে পারে মেলা। বাংলা একাডেমি থেকে উদ্যানে প্রবেশর সময়ও কাঁদা জমে থাকতে দেখা গেছে। মূল মেলায় নিয়ে যাবেÑ এমন কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাটির ডিবি, পাথর, নির্মাণ সামগ্রীসহ নানা ময়লা আবর্জনা পায়ে মাড়িয়ে সামনে এগোতে হয়েছে। স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোও খুব কাছাকাছি। ফলে একটা বাজারের চেহারা পেয়েছে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আগামীর প্যাভিলিয়নে কথা হচ্ছিল বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনিও ভীষণ বিরক্ত।
প্রথমেই বললেন, এটা তো বইয়ের মেলা নয়। বইয়ের হাট হয়েছে। এত নোংরা, কী বলবো! তার মতে, শত শত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দেখছি মেলায়। আসলে তো বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ৫০টির বেশি হবে না। এ অবস্থায় বইমেলার চরিত্র ফিরিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
একই দিন অভিন্ন আড্ডায় প্রকাশক নেতা ওসমান গনি বলছিলেন, মেলা উপলক্ষে কাগজ নষ্ট হচ্ছে অনেক। হাজার হাজার বই প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু আপনাকে ভাবাতে পারে এমন বই কতটা হচ্ছে? মানসম্পন্ন বই না পেলে মেলার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে বলে মত দেন তিনি। পাইরেটেড বইও বিক্রি হচ্ছে জানিয়ে তা বন্ধের দাবি জানান তিনি।
এদিন মেলায় দেখা গেছে জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হককেও।
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন তিনি। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়া চীন’র গ্রাফিক্স নভেল ভার্সন নিয়ে কথাও বলতে দেখা যায় তাকে। লেখক কবিদের মধ্যে আরও অনেকেই এসেছিলেন। বিভিন্ন স্টলের সামনে বসে গল্প আড্ডা জমিয়েছেন তারা। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফেব্রুয়ারির শেষদিন পর্যন্ত এইসব গল্প আড্ডা চলমান থাকবে।
৩১ নতুন বই ॥ মেলার দ্বিতীয় দিনে বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়েছে নতুন ৩১টি বই।
বইমেলার মূলমঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেলে বইমেলার মূল মঞ্চে ছিল আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ‘মহাকবি আলাওল’ শীর্ষক সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইমন জাকারিয়া। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মিল্টন বিশ্বাস এবং মোহাম্মদ শেখ সাদী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মো. আবুল কাসেম।