বিজয় দিবসে শনিবার গোটা রাজধানীজুড়েই ছিল উৎসব অনুষ্ঠান। প্রায় সব অনুষ্ঠানে উড়তে দেখা গেছে জাতীয় পতাকা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াই সংগ্রাম এবং ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত পতাকার রং ছড়িয়ে পড়েছিল শহরের আনাচে কানাচে। এর পরও বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রবেশ করে চারপাশটাকে নতুন মনে হলো। এখানে অভিন্ন রং। তবে রংটিকে জোরালো ভাষা দিতে পেরেছিলেন আয়োজকরা। ফলে চৈতন্যে গভীর দোলা দিয়ে গেছে।
প্রতিবারের মতো এবারও বিশাল মাঠের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছিল চারকোনা মঞ্চ। ভূমি থেকে বেশ উঁচুতে দৃশ্যমান মঞ্চটি ছিল সবুজ রঙের। এর ওপরে লাল পোশাক পরা শিল্পীরা সংগীত নৃত্য ইত্যাদি পরিবেশন করেন। নিচে মঞ্চ ঘিরে বসেন যন্ত্রসংগীত শিল্পী ও সম্মেলক গানের শিল্পীরা। তাদের সঙ্গে ছিল ছায়ানটসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। সাধারণ দর্শনার্থীদের কেউ মাঠে বসেছিলেন। কেউ বসেছিলেন গ্যালারিতে। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার মানুষ। সবারই পোশাকে পতাকার রং। দেখে বারবারই মনে হয়েছে, লাল–সবুজের এত সুন্দর মিলনমেলা আর হয় না। বিপুল সমাবেশ উৎসবের আনন্দ যেমন ছড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি বজায় রেখেছিল ভাবগাম্ভীর্য।
১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা মাথায় রেখে বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে শুরু করা হয় অনুষ্ঠান। জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু। মঞ্চের শিল্পীদের সঙ্গে গোটা মাঠ একসঙ্গে গেয়ে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ এ সময় জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন অনুষ্ঠানের সহ–আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য মকসুদ কামাল, ছায়ানটের সহসভাপতি ডা. সারওয়ার আলী, খায়রুল আনাম শাকিল ও সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহম লিসা।
মূল অনুষ্ঠানমালায় ছিল একক ও দলীয় সংগীত। নৃত্যায়োজন ছিল। ছিল পাঠ। এসব পরিবেশনার মধ্য দিয়ে বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশভক্তির কথা তুলে ধরা হয়। প্রথমেই সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হয় ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ কবিগুরুর এ গান গানের অধিক, প্রার্থনার মতো শোনায়। নিচে বসে যখন শিল্পীরা গানটি গাইছিলেন তখন মঞ্চে ছিল চমৎকার কোরিওগ্রাফি। একইভাবে মুগ্ধ করে নজরুলের ‘আজি রক্ত নিশি– ভোরে।’ সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া এই গানের সঙ্গেও ছিল নাচ। লোক গান ‘এই না বাংলাদেশের গান গাইতে রে’ শুনে চোখ ভিজে গেছে অনেকের।
আর বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট শুনে।’ হ্যাঁ, সম্প্রতি ভারতে বিদ্রোহী কবির এই কালজয়ী গান বিকৃত করে গাওয়া হয়েছে। এরই প্রতিবাদ ছিল ছায়ানটের তিন শিক্ষকের পরিবেশনাটি। বিজয় দিবসের আনন্দ আবেগকে গভীরভাবে ধারণ করেছিল ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি। অধিকাংশ গানের সঙ্গেই ছিল নাচ। এ নাচ দারুণ উপভোগ করেছেন দর্শক। এর বাইরে অনবদ্য পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে ছিলেন অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার। সৈয়দ শামসুল হকের কালজয়ী নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ থেকে একটি অংশ পরিবেশন করেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদারদের ধর্ষণের শিকার নারীর বেদনা তুলে ধরেন তিনি। তার কান্না গ্যালারিতে বসা দর্শককেও ছুঁয়ে দিয়ে যায়। শুরুর মতো শেষটাও হয় জাতীয় সংগীত দিয়ে। যারা সবার সঙ্গে জাতীয় সংগীত গেয়েছেন, যারা উপভোগ করেছেন ছায়ানটের অনুষ্ঠান নিশ্চিত অনেকদিন মনে রাখবেন।