স্বাধীনতা ও ধার্মিকতা কী অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বা জড়ানোর সম্ভাবনা আছে। আসুন না, একটু ভেবে দেখি। স্বাধীকার প্রত্যেকের প্রয়োজন। একটি বৃক্ষের কথাই বলুন, শক্তি সামর্থে, কলেবরে প্রবৃদ্ধি লাভের জন্য তাকে অবশ্যই উন্মুক্ত থাকতে হবে যথাযথ আলো বাতাস লাভের জন্য। গাছের একটি চারা রোপন করার পর দীর্ঘ দিন ঢেকে রাখা হলে তা বিবর্ণ ও মারা যেতে বাধ্য। ডিমের মধ্যে বাচ্চাটি খোলস ভেদ করে খোলা হাওয়ায় না আসতে পারলে পরিপূর্ণতা লাভ করা সম্ভব নয়। যে শিশু মারাত্মক রোগে থাকে আক্রান্ত তা তো পঙ্গুর পর্যায়ে পড়ে থাকতে বাধ্য, যা কেবল জ্বালা বাড়ায়। আর স্বাধীনতা নিয়ে কথা তোলার সাথে সাথে মানবজাতির কথাই মনে ভেসে ওঠে। বিগত ২০০ বছর (১৭৫৭–১৯৪৭) ভারতবর্ষ বৃটিশ কলোনী হিসেবে শাসিত হয়েছে। রক্তের মূল্যে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
স্বাধিকার আর পরাধিকার শব্দ দুটো বিপরীত ধর্মী। মানুষ আসলে খোদার হাতে হয়েছে সৃষ্টÑ মূলত মানুষ খোদার প্রতিনিধি। মানুষের প্রথম আভাস ভূমি হলো এদন কানন। কালামপাকের বর্ণনা অনুসারে ওই কাননে মানুষের প্রয়োজনীয় সব কিছুই ছিল পরিপাটি। বর্তমানে অনেক নির্জন দ্বীপ পাওয়া যায়, যেখানে ফলফলাদির কোনো অভাব নেই। প্রাজ্ঞ আল্লাহপাকের পরিকল্পনা বিরুদ্ধে আদম হাওয়া যখন পদক্ষেপ নিলেন, অমনি তাদের তাড়িয়ে দিলেন পূতপবিত্র বাগান থেকে। মানুষ অসহায় হয়ে পড়লো। ধার্মিকতা খুইয়ে ফেলার সাথে সাথে প্রাচুর্যটুকু বন্ধ হয়ে গেল। বাধ্য হলো মানবেতর জীবনযাপন করতে। কোনো এক সংখ্যায়, প্রচ্ছদে ৯ বছরের একটি শিশুর ছবি ছেপে ছিলাম। শিশুটি জীবিকা অর্জন করতো বাদামের ডালি গলায় ঝুলিয়ে ফেরি করে। ও জেনেছিল ও স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক, তাই মনে মনে গুণগুণ করে এমন গান করত, ‘স্বাধীন দেশের আমি স্বাধীন নাগরিক, বাবুদের ছেলেরা যখন বসে পাঠে, ছুটে চলি আমি মাঠে ঘাটে, নতুবা দিন আমার উপোষে কাটে, আপনারাই বলুন, নই কী নাগরিক আমি স্বাধীন বটে।’ এক বন্ধু অভিযোগ করলো, ভাইরে, নিরন্নদের অন্নদান করাও যাবে না, এমন দেশে বাস করছি। কথাটা আমি জানতে চাইলাম খোলাখুলি ভাবে। বন্ধুটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তার ছোট্ট একটা কারখানা আছে। পথকলি অর্থাৎ রেলস্টেশনে ও বাসস্টেশনে যে সকল ছেলে–মেয়ে খেয়ে না খেয়ে জীবন টেনে টেনে চলছে তাদের কাজ শিখানোর জন্যই গুটি কয়েক শিশু জড়ো করেছিলাম। প্রশাসনের লোক এসে হাজির, আপনার কারখানায় শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন, যা একটা অপরাধ, বা ক্রাইম। সে অথরিটিকে বুঝাতে চাইলো, ওই শিশুরা না খেয়ে অপরাধের পথে পা বাড়াচ্ছিল। কেউ তাদের দুমুঠো অন্নের ব্যবস্থা করে না পথ কলিদের। মাদার তেরেসার সে মনোভাব ছিল। বন্ধুটি সাহসের সাথে বললো। কারখানায় শিশুরা দুমুটো খাবার পায়, তবে পথে ঘাটে এতোটুকু নিশ্চয়তা তাদের ছিল না। সরকার হলো গৃহকর্তা, আর নাগরিক সরকারকে মান্য করে চলবে, যা সকল সরকারের দাবি। তবে নাগরিকের রয়েছে দায়িত্ব, কর্তব্য ও অধিকার। কোনো নাগরিক নিরন্ন মারা যাক তা সরকারের কাম্য নয়। অবশ্য আদর্শ সরকারের সাথে সচেতন নাগরিক সহযোগিতা করে থাকে। আসলে, সরকার জনগণের, কথাটা আব্রাহাম লিংকন এভাবে বলেছেন, Government of the people, by the people and for the people. তাই কোনো ব্যক্তি যদি বেকার থাকে, বা অর্থভাবে না খেয়ে অথবা চিকিৎসাবিনে মারা যায়, তবে সরকারকেই জবাবদিহি হতে হবে। আমরা কী তেমন সরকার আজ পর্যন্ত পেয়েছি।
ধার্মিকতার প্রশ্নে আলোচনা করা হলে একই ধরনের দৃশ্য নজরে পড়বে। ধার্মিকতা কেবল কতিপয় বাহ্যিক চিহ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। ব্যাংকে টাকা তুলতে চেক জমা দেবেন, আপনাকে ওই চেকের পরিবর্তে একটি টোকেন ধরিয়ে দেবে। আপনি যদি মনে করেন ওই টোকেন মানেই টাকা, আর পাওনা দারদের হাতে ওই টোকেন গুঁজে দিতে চান, তবে তারা আপনাকে পাগল ভাববে। টোকেন দেয়া হয়েছে প্রমাণ স্বরূপ, যেন ততক্ষণে আপনার একাউন্ট থেকে ওই টাকা তোলা হয়েছে দেখিয়ে আপনার হাতে তা তুলে দিতে পারে। টাকা দেয়ার সময় টোকেনটি অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হয়।
যে দেশে মানুষ অসহায়, অন্নবস্ত্র বাসস্থানের নিশ্চয়তা নেই, নেই শিক্ষা দীক্ষার নিশ্চয়তা, না বুঝেও বিদেশি ভাষায় তপজপ করতে বাধ্য, তারা নেহায়েত পরাধিন জাতি, তবে এক্ষেত্রে পরাধিনতার শৃঙ্খল হলো অদৃশ্য। আজ গোটা বিশ্বের মানুষ তেমনি পরাধিন। অবশ্য অধার্মিক তো বটেই।
আজ আমার মোবাইলে চার্জ দিচ্ছিলাম মিউচ্যুয়াল গ্রাফিক্সে বসে। সেখানে হরেক রকম লোকের আনাগোনা যারা শিল্পসাহিত্যের সাথে সম্পৃক্ত।
কর্তৃপক্ষের একজন বললেন, একটু খেয়াল রাখবেন মোবাইলের দিকে। তার অর্থ সুযোগ বুঝে দাও মারার মনভাবের লোকও ওখানে আসা যাওয়া করে। কথাটা শুনে আপনি হয়ত বলবেন, নতুন করে পুরাতন ঘটনা আওড়াচ্ছেন। আদমের বিতাড়িত হবার পর থেকে তার ঔরষে পূতপবিত্র ব্যক্তির জন্ম হওয়া সম্ভব ছিল না, সকলেই পাপি এবং ভ্রাতৃহন্তা। আমরা সকলে আদমের ঔরষে পয়দা হয়েছি। সকলে আদমি। আমরা কেউই শতভাগ ধার্মিক হতে পারি না, তেমন প্রত্যাশা করা সম্পূর্ণ বেমানান। প্রকৃত স্বাধীনতা হলো ‘মুক্তপাপ’ জীবনযাপন করা। একজন ‘মুক্তপাপ’ ব্যক্তি খোদ আল্লাহপাকের অবিকল প্রতিনিধি। খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহ হলেন মানবরূপে আবির্ভূত ঐশী কালাম ও পাকরূহ। আমরা যে অবস্থাকে স্বাধীনতা মনে করি আসলে স্বাধীনতা যে কী তা আমাদের জ্ঞানে ধরে না। ধার্মিকতা বিহীন স্বাধীনতা আত্মকেন্দ্রীকতা, অনৈতিকতা, দূর্নীতিতেভরা জীবন–যাপন করা যার প্রমাণ সমস্যাপীড়িত বাংলাদেশ। এখানে খাদ্যে ভেজাল দেবার লোক পাবেন, ঔষধে ভেজাল দেবার দানব পাবেন, প্রেমে হেরে গেলে প্রেমিকার মুখে এসিড মেরে ঝলসে দেবার লোক পাবেন, এককথায় পাপের বিষে আক্রান্ত এখানে সবকিছুই আছে। এ দেশে ভূমি দস্যু, বন দস্যূ, জল দস্যূ, ঘুষখোর, ফতোয়াবাজ, রাজাকার–আলবদর, ধোকাবাজ, দুষ্ট আমলা, ঘাতক–দালাল ধর্মের নামে ব্যসাতি করার লোকের ঘাটতি নেই। স্বাধীন ধার্মিক ব্যক্তি কেন চন্দ্র সূর্যের গতির সাথে তাল মিলাবে। চন্দ্র সূর্য ব্যক্তির সেবার জন্য হয়েছে নির্মিত্ মানুষ মানুষের খেদমতে নিয়োজিত থাকবে এটাইতো আসল ধার্মিকতা এবং স্বাধীনতার মূল সুর। স্বাধীনতা না থাকলে ধার্মিকতা থাকতে পারে না। আল্লাহপাক মানুষকে স্বাধীন ও ধার্মিক করে সৃষ্টি করেছে। অভিশপ্ত ইবলিশের কবলে পড়ে মানুষ হারিয়েছে স্বাধীনতা ও ধার্মিকতা।
স্বাধীনতা ও ধার্মিকতাকে অবশ্যই এক সূত্রে গেথে রাখতে হবে। একজন অধার্মিক স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে না। কতিপয় অসাধু বণিক সম্প্রদায় স্বাধীনতা ও ধার্মিকতা কব্জা করে রেখেছে। তাদের কব্জা থেকে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে কাঙ্খিত স্বাধীনতা, পবিত্রতা ও ধার্মিকতা। এর জন্য চাই ঐশী ধন। চাই পাকরূহের পরিচালনা, নির্দেশনা ও শক্তি। চাই আন্তরিকভাবে সমর্পণ, কেবল মাবুদের হাতে। তিনিই অনন্ত অসীম প্রেমময়। তিনিই আমাদের দরদিজনা। প্রেমের আধার, প্রেমের পরাকষ্টা, নির্ভয়ে তাঁর হাতে হয়েছি আমরা সমর্পিত।