যানজট থেকে রেহাই নেই নগরবাসীর। চলার গতি হঠাৎ থমকে যায় দীর্ঘ যানজটে। এ অসহনীয় যানজটের মূল কারণ রাস্তার পাশে অবৈধ গাড়ি পার্কিং ও ফুটপাত দখল করে বসা হকাররা। নগরীর অনেক ফুটপাত বেদখলে। সেই সঙ্গে রাস্তার পাশে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং তো আছেই। বিশেষ করে নিউমার্কেটের দক্ষিণ পাশের ব্যস্ত সড়কটিও বাদ নেই অবৈধ গাড়ি পার্কিং আর হকারদের দখল থেকে। এ সড়কের দুই পাশে দিনভর অসংখ্য গাড়ি পার্ক করে রাখার কারণে গাড়ি চলাচলের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হওয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকে এসব এলাকায়। ফলে এই এলাকার যাতায়াতকারীদের ভোগান্তির শেষ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলের ছাত্রীদের ঐ সড়ক দিয়ে চলাচল করতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ওপর যত্রতত্র অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে যানজট লেগে থাকে সব সময়। ভুক্তভোগী বেসরকারি চাকরিজীবী রহিম উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে হয়। এক মহিলার হাতব্যাগ ছিনতাই করে পালিয়ে যায় এক যুবক। রাস্তার পাশেই লাইন ধরে গাড়িগুলো পার্কিং করে রাখার কারণে যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয় আমাদের। অনেকক্ষণ গাড়িতে বসে থাকার পর পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে ফিরছি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নিউমার্কেটের দক্ষিণ গেটে পার্কিংয়ের কারণে মূল রাস্তাটি সরু হয়ে গেছে। মার্কেটের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সড়কের বিশাল এলাকা জুড়ে নিয়মিত পার্কিং চলছে। আর এই অবৈধ পার্কিংকে পুঁজি করে আবার চলছে টোকেন বাণিজ্য। রাস্তার ওপর কেউ এসে প্রাইভেট কার বা মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়ালেই তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে পার্কিং টোকেন। নেওয়া হচ্ছে ২০ থেকে ৫০ টাকা করে। রাজধানীর ব্যস্ততম এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল রোড থেকে নিউমার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেটের মোড়ে এসেছেন বাবু সাহেব তারা। তিনি মোটরসাইকেল রাখা মাত্রই দুই জন লোক ছুটে এলেন। তারা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নামে একটি পার্কিং টোকেন ধরিয়ে দিয়ে ৩০ টাকা আদায় করলেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই পার্কিংগুলো যখনই উচ্ছেদ করতে যাই তখনই দেখা যায়, কোন গাড়ি সচিবের, কোন গাড়ি মন্ত্রীর আত্মীয়ের, কোন গাড়ি কোন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার। ফলে ড্রাইভারেরাই আমাদের সার্জেন্টদের চাকরি খেয়ে ফেলার ভয় দেখায়। কোন গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে উচ্চ পর্যায় থেকে ফোন আসে। ফলে চেষ্টা করেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, নিউমার্কেটে প্রবেশে চারটি গেট রয়েছে। ডিএসসিসি গেটসংলগ্ন একটি রাস্তার অংশও পার্কিংয়ের জন্য ইজারা দিয়েছে। কিন্তু বাকি তিনটি গেটের পার্কিং থেকেও টাকা তোলা হয়। ডিএসসিসির নাম ও লোগো সংবলিত রসিদ দিয়ে টাকা আদায় করা হচ্ছে। ডিএসসিসি প্রতিটি গাড়ির জন্য ১৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও এখানে ২০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া পুরানা পল্টন লেনের রাস্তার বা বিজিবি গেটের সামনে দিয়ে বটতলা হয়ে বনলতা মার্কেটের সামনের রাস্তায় যানবাহন চলাচল করলেও ২০ টাকা করে দিতে হয়। এ নিয়ে প্রায়ই যানবাহনচালক আর মালিকদের সঙ্গে টাকা আদায়কারীর ঝগড়া লেগেই থাকে।
নিউমার্কেট এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আসা মেসবাহ য়াযাদ বলেন, ‘একটি সাদা রঙের টোকেন (ঢাকা নিউমার্কেট কমপ্লেক্স–ইজারাদার রিমন এন্টারপ্রাইজ) দিয়ে আমার কাছ থেকে ৩০ টাকা আদায় করে। ওরা গাড়িভেদে গাড়িচালক বা মালিকদের কাছ থেকে টোকেন দিয়ে চাঁদা তোলেন।’
নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, এই এলাকায় পার্কিংয়ের ইজারা কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে একটি সিন্ডিকেট। তারা পার্কিংয়ের নামে বছরে কমপক্ষে সাড়ে ৩ কোটি টাকা আদায় করলেও ডিএসসিসি কোষাগারে জমা হয় নামমাত্র অর্থ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ‘অবৈধ পার্কিংয়ের বিষয়ে আমরা সব সময় নিরুত্সাহিত করি। এমনকি প্রধান সড়কগুলোতে জরিমানাও করে থাকি।’
এদিকে নগরবিদেরা বলছেন, সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করলে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা কঠিন হবে। কারণ, নগরীতে চাহিদা অনুযায়ী পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ভবন নির্মাণ করলে সেটাতে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ভবন কমার্শিয়াল হলে, পার্কিংয়ের জায়গাও বেশি থাকতে হবে। অথচ নগরীর বিভিন্ন মার্কেটে পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে বসানো হচ্ছে দোকানপাট।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, শহরে অনেক বড় রাস্তা রয়েছে, কিন্তু অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে তার ব্যবহার ৩০ শতাংশের বেশি হচ্ছে না। যানজট কমাতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।