বাঙালিয়ানার নবান্নের মাস অগ্রহায়ণে বাজার মেতেছে আগাম জাতের নতুন আলু। জমি থেকে এই নতুন আলু উত্তোলনে ধুম পড়েছে। দলবেঁধে খেত থেকে আলু উত্তোলন করে তা বস্তায় ভরে বাজারজাত করছেন আলু চাষিরা।
শীতের সবজি হিসাবে যেমন বাজারে নতুন ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, বরবটি পাওয়া যাচ্ছে ঠিক তেমনি নতুন আলু পাওয়া গেল এবার। আমন ধানে ভরে উঠেছে কৃষকদের বাড়ি। তেমনিভাবে আগাম আলুর আলোয় উদ্ভাসিতও হচ্ছে। নতুন আলুর চমক এখন ভোক্তাদের মাঝে। দাম যাই হোক নবান্নের আমেজে নতুন ধানের চালের ভাতের সঙ্গে নতুন আলুর ভর্তা বা তরকারির এক নতুন স্বাদ তো মিলছে। নবান্নে নানা ধরনের সবজির সঙ্গে নতুন আলু মিশিয়ে বাহারি তরকারির কদরও বেশি। তাই নতুন আলু পেয়ে ভোক্তারাও বেশ খুশি।
নীলফামারী সদর ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলার আগাম আলু উৎপাদনের সূতিকাগার বলেই পরিচিত। এখানকার আগাম আলু এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাট বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। রংপুর অঞ্চলে রবি মৌসুমে অর্থকরী ফসল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আলু। এ ছাড়া এক সময়ের পতিত থাকা তিস্তা চরে আলুর বাম্পার ফলন হচ্ছে। চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের রংপুর কৃষি অঞ্চলের ৫ জেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে নীলফামারী জেলায় প্রায় ২২ হাজার হেক্টরে। তারমধ্যে আগাম আলু চাষ হয়েছে ৮ হাজার হেক্টরে শুধু নীলফামারী জেলাতেই। শনিবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রোপণের ৬৫ দিনের মধ্যেই শুক্রবার থেকে জমি থেকে আগাম জাতের এই নতুন আলু উত্তোলনে ধুম পড়ে। দলবেঁধে খেত থেকে আলু উত্তোলন করে তা বস্তায় ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। ঢাকা, কুমিল্লা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা যেন লাইন করে দাঁড়িয়ে আছেন। গত দুইদিন ধরে চলছে বিকিকিনি। ব্যবসায়ীরা খরিদ করছেন প্রকার ভেদে ৮০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে। জমির ধারে দাঁড়িয়ে ট্রাক। ওজন করে বস্তায় ভরছে– এরপর ট্রাকে করে রাজধানীর বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে এই আলু।
আলু চাষিরা জানালেন, নীলফামারী সদর ও কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় সেভেন, বারী–৪০, বারী–৪৬ ও গ্র্যানুলা জাতের আগাম আলু এবার আবাদ করা হয়। এবার একটু দেরিতেই নতুন আলু বাজারে এলো। মধ্য আশ্বিনেই মঙ্গা বা অভাব তাড়ানোর আগাম আমন ধান ঘরে তুলেই আগাম আলু উৎপাদনের মাঠে নেমেছিল তারা। আগাম জাতের আলু রোপণের শুরুতেই একটু ধাক্কা খেতে হয়েছে। রোপণের ১০ দিন যেতে না যেতে অতিরিক্ত বৃষ্টির কবলে পড়তে হয়। ফলে বৃষ্টির পানিতে বেশ ক্ষতির মুখে পড়ে কৃষক। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আলু চাষিরা আগাম আলু তুলেই সেই জমিতে পুনরায় আলু রোপণ শুরু করে দিয়েছে। উপজেলার বাহাগিলি, চাঁদখানা, গাড়াগ্রাম, নিতাই প্রভৃতি এলাকায় আলুর মাঠে কেউ মাটি খুঁড়ছেন, কেউ কুড়াচ্ছেন আর কেউ ঠেসে ঠেসে বস্তা ভরছেন। কোথাও আবার ডিজিটাল মিটারে চলছে ওজন।
খেতের মাঝে ভর্তি হচ্ছে ভ্যান, ট্রলি ও ট্রাক। খেতের মধ্যে আলু তোলার এমন দৃশ্যবিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে। জেলা সদরের সিংদই গ্রামের আলু চাষি ইউনুছ আলী (৫১) জানালেন ৩ বিঘা জমিতে তিনি আগাম আলু চাষ করেছেন। পাইকারের কাছে খেতেই আলুর কেজি তিনি ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। শুরুতেই এমন দাম পেয়ে তিনি বেজায় খুশি।
আলু ব্যবসায়ী রোস্তম আলি বলেন, ভোরে উঠেই আলু খেতে দৌড় দিতে হয়। খেত থেকে আলু উঠিয়ে ওজন করে চাষিকে নগদ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বাজারে প্রেরণ করি। তিনি বললেন চাহিদা অনুযায়ী এখন প্রচুর আলু পাওয়া যাচ্ছে। তাই এই আলু ট্রাকে তুলে ঢাকা বা অন্য জেলায় পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। হরতাল অবরোধ শুরু হলে আগামজাতের এই আলু দাম কমে যাবে।
নীলফামারীর বড়বাজারে নতুন আলুর ভোক্তা আব্দুর রশিদ বলেন, দাম যাই হোক। নতুন আলুর স্বাদ আলাদা। হিমঘরের আলু বেশি মিষ্টি হওয়ায় নতুন আলুর প্রতি কার না মনটানে।
আলুর পাইকারি ক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, বাজারে এখন আগাম জাতের আলু উঠতে শুরু করেছে। এসব আলু ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আড়তে সরবরাহ করা হচ্ছে। কাঁচা বাজারের মূল্য সঠিকভাবে বলা যায় না।
কিশোরীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লোকমান আলম বলেন, চলতি বছর এই উপজেলায় ৬ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আগাম আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬০০ হেক্টর আগাম আলু আবাদ করা হয়। বাজারে নতুন আলু উঠতে শুরু হয়েছে। চলতি বছর অনুকূল আবহাওয়ায় আলুর বা¤পার ফলন হয়েছে। আগাম আলু, আগাম ধান চাষ করে এ অঞ্চলের মানুষ ভাগ্যের পরিবর্তন আনছেন।