দেশের বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। তাতেও নিয়ন্ত্রণে না আসায় গত মাসে আরো কয়েকটি পণ্যের সঙ্গে দেশি পেঁয়াজের দামও বেঁধে দেয় সরকার। এতে ভোক্তা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। বেঁধে দেয়ার এক মাস পার হলেও দামতো কমেইনি বরং প্রতি সপ্তাহেই আরও বাড়ছে তা। গত এক বছর দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।
একটু কমে পাওয়া যেতে পারে, সেই ভেবে পেঁয়াজ কিনতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি আড়তে এসেছিলেন আলমগীর শরিফ। তার সঙ্গে কথা হলো তখন। সংবাদকে তিনি বলেন, ‘যে ভাবে দাম বাড়ছে, কখন যে আবার আড়াইশ’ (২৫০ টাকা) হয়ে যায়– সেই ভয়ে এক পাল্লা (৫ কেজি) দেশি পেঁয়াজ কিনলাম। দাম নিল ৬৭০ টাকা।’
ক্ষুব্ধ সেই ক্রেতা যোগ করেন, ‘মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর পেটের চিন্তা করে না, কতো তাড়াতাড়ি গাড়ি–বাড়ি করা যায়। এ জন্যই দাম বাড়ে।’
একই অবস্থা আলুর দামের ক্ষেত্রেও। দামও বাড়তে থাকায় আলুর দাম ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। অভিযান, জরিমানা করেও কাজ হয়নি, দেশের বাজারে কার্যকর হয়নি সরকারি দাম। এই পরিস্থিতিতে দাম কমানোর আশায় গত বুধবার আবারও আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
রাজধানীর অন্যান্য বাজারের থেকে কারওয়ান বাজারে বেশকিছু নিত্যপণ্য একটু কম দামে বিক্রি হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও শুক্রবার (৩ নভেম্বর) ওই বাজারেই ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকা কেজি দরে। আর ওই বাজারে পাইকারিতে এক পাল্লা (৫ কেজি) দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬৭০ টাকা অর্থাৎ কেজি ১৩৪ টাকা। আর অন্য বাজারগুলোতে, মহল্লার দোকানে তা ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। গত সপ্তাহে বাজারভেদে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল কেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারভেদে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম কেজিতে গড়ে ২৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।
বাজারে শীতের সবজির সরবরাহ একটু বাড়লেও কমেনি দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে নতুন সবজি আসতে শুরু করলেও দেশে রাজনৈতি অবরোধ থাকায় প্রভাব পড়েনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ অক্টোবর আলু আমদানির অনুমতি দেয়ার পর গত বৃহস্পতিবার ভারত থেকে ৭৭ টন আলু এসেছে। কিন্তু দামে তার প্রভাব পড়েনি। এখনও সেটা বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারেই খুচরায় আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। আর এ বাজারের পাইকারিতে পাল্লা হিসেবে আলু বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী মিজান সংবাদকে বলেন, ‘আমরা পাল্লা বিক্রি করছি ২৬০ টাকায়। আমাদের কাছ থেকে আলু নিয়ে খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন বাজারে কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি করেন। এক পাল্লায় সাত থেকে আট টাকা লাভ হয়।’
তিনি বলেন, আলু আমদানি হলেও নতুন আলু বাজারে না আসা পর্যন্ত আলুর দাম কমবে না।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর ঢাকা মহানগরীর শুক্রবারের (৩ নভেম্বর) দরদামের হিসেবে, এক বছরে দেশি পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ১২৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। আর আলুর ক্ষেত্রে বৃদ্ধির সেই হার ১০৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে এ বছর গোল আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ টন। ওই মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এ সময়ে আলুর উৎপাদন ১ কোটি ১১ লাখ টন। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, আলু উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আলুর চাহিদা ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টন। আর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে তা ৮৯ লাখ টন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে কেজিতে ১১ টাকা ৫১ পয়সা। আর দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ৩৩ টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চিনি আমদানিতে শুল্ক কমালেও কমেনি চিনির দাম। শুক্রবারও রাজধানীর খোলা বাজারে খোলা সাদা চিনি বিক্রি হয়েছে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে।
‘যা দাম চায়, তাই দিতে হয়। দরদাম করে কোন লাভ হয় না,’ বাজারে আসা আরেক ক্রেতা বলেন সংবাদকে।
মাছ, মাংস ও ডিমের বেড়ে যাওয়া দাম এখনো কমেনি। বাজারে ফার্মের মুরগির লাল রঙের ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায়।
মাছের বাজারে এক কেজি ওপর ওজনের রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে কেজি ৩১০ থেকে ৪৫০ টাকায়। আর কাতল মাছ ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকায়। এছাড়া চাষের পাঙাশ মাছ কেজি ২০০ থেকে ২৪০ টাকা, কই ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০ থেকে ২৫০ টাকা, পাবদা ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, শিং ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খোলা বাজারে ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ২১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া সোনালি জাতের মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি ৩০০ থেকে ৩১০ টাকা আর দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকায়। পাশাপাশি গরুর মাংস কেজি ৭৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, ছাগলের মাংস ১,০০০ টাকা, খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ টাকায়।
বাজারে পটলসহ বেশিরভাগ সবজি ৮০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। আর বাজারভেদে, গাঁজর, টমেটো, বরবটি ও শিম কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারও জাতভেদে বেগুন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭০ থেকে ১২০ টাকায়। এছাড়া বাজারে পিস হিসেবে লাউ ৮০ থেকে ৯০ টাকা, ফুলকপি ৬০ থেকে ৭০ টাকা, বাঁধাকপি ৬০ টাকা ও চাল কুমড়া ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে কম দামের সবজির মধ্যে মিষ্টি কুমড়া ৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা আর মূলা ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে, রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা বাজারে যে পটল পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকায়, রাজধানীর বাজারে সেই পটল খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়।
ঢাকার খোলা বাজারে বিআর আটাশের চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায়। আর মিনিকেট জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭২ টাকায়। মুদি দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, এখনো বাড়তি দামে জিরা মসলা বিক্রি হচ্ছে কেজি ১২০০ টাকায়।
শুক্রবার রাজধানী কয়েকটি বাজার ঘুরে ক্রেতা–বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া যায়।