আট বছর আগের এক ঝড়ের দিনে একটি বিড়ালছানা কুড়িয়ে এনেছিলেন গৃহবধূ জাহানারা খানম ওরফে মুক্তা। জাহানারার দুই মেয়ে ও স্বামীর সঙ্গে বিড়ালটিও একসময় পরিবারের সদস্য হয়ে ওঠে। এরপর মেয়েরা পড়াশোনার জন্য দেশ ছেড়েছেন। স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু জাহানারা একা হয়ে যাননি। তার ঘরে এখন কুড়িয়ে আনা ৮০টি বিড়াল।
নারায়ণগঞ্জ সদরের পশ্চিম মাসদাইর এলাকার একটি বহুতল ভবনে ১৩৫০ বর্গফুটের মুখোমুখি দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন জাহানারা। তাঁর ভাষায়, ‘দুটি ফ্ল্যাটই বিড়ালদের, তাদের সঙ্গে আমি থাকি।’ বিড়ালগুলোকে নিজের সন্তান বলে জানেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সেই ‘সন্তানদের’ দত্তক দেওয়ার খবরে আলোচনায় এসেছেন তিনি। সম্প্রতি ‘সারিতা হোসেন’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ৮০টি বিড়াল দত্তক দেওয়ার খবর জানানো হলে মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে।
জাহানারার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে প্রথমে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশে অসম্মতি জানান। তাঁর যুক্তি, ‘এটা আমি মানুষ হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি।’ শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হন। বাড়ির খোঁজ পেতে পশ্চিম মাসদাইরে গিয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করতে বলেন। বিপত্তি বাধে তাঁর দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে। মুঠোফোনে তাঁকে আর পাওয়া যায় না। পশ্চিম মাসদাইর এলাকায় এক দোকানির কাছে জানতে চাই এলাকায় বিড়াল পোষেন কে? এক মুহূর্ত দেরি না করে দোকানি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘মুক্তা আপার কথা বলতেছেন, বিড়ালের মা?’ হ্যাঁ সূচক উত্তর দিতেই দোকানি নীল কমল নামে একটি বহুতল ভবন দেখিয়ে দেন। ভবনের সপ্তম তলায় গেলে কানে ভেসে আসে বিড়ালের মিউমিউ শব্দ।
জাহানারার বাসার ভেতরে পা রাখতেই চোখ ছানাবড়া হওয়ার অবস্থা। এ যেন বিড়ালের রাজ্য। বাসার ছোট্ট চৌকি, দেয়ালে ঝোলানো তাক, ওভেন, খাঁচা, রান্নাঘর, বারান্দা সব জায়গায় বিড়াল। সবাই দিগ্বিদিক ছুটছে। ‘বাড়িতে কখনো অপরিচিত লোক আসে না। আপনাদের দেখে তাই কিছুটা ভয় পেয়েছে।’ জাহানারার কথা শেষ না হতেই ,‘আয় আয়, আসো মা আসো’ বলে ডাকতে থাকেন।
জাহানারার ডাকে তাঁর চারপাশ ঘিরে ধরল বিড়ালগুলো। বাড়িতে আগন্তুক দেখে ওদের চোখমুখে যে ভয় ফুটে উঠেছিল, তা যেন মুহূর্তে কেটে গেল। কেউ কেউ আহ্লাদী ঢঙে জাহানারার পায়ে শরীর ঘষতে শুরু করল। কেউ লাফিয়ে কোলে উঠতে চাইল। জাহানারা এর মধ্যে একটিকে কোলে তুলে আদর করে দিলেন। বললেন, ‘ওর নাম নুদু। ওর শরীরটা ভালো না। জ্বর হইছে।’
নুদুর মতো প্রতিটি বিড়ালের আলাদা করে নাম দিয়েছেন জাহানারা। কার কী নাম, কার পায়ে ব্যথা, কার ইদানীং খাবার খেতে সমস্যা হচ্ছে, কোনগুলো পক্ষাঘাতগ্রস্ত, কে বেশি আদুরে, কার জেদ বেশি—আলাপে আলাপে সবই বললেন।
এরপর জাহানারা নিয়ে গেলেন তাঁর দক্ষিণমুখী বাসায়। ‘এটাতে বয়স্ক বিড়ালরা থাকে। ওদের সঙ্গে আমিও। আগে সবাই একসঙ্গেই থাকতাম। কিন্তু বিড়ালের দুষ্টুমি আর গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মীয়স্বজন বাড়িতে আসেন না। তাই আলাদা দুটি ফ্ল্যাট নিতে হলো’—বললেন জাহানারা।
যেভাবে শুরু
আট বছর আগের কথা। দুই মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ও আফিয়া জাহিনকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতে থাকেন। স্বামী আফজাল তালুকদার ইতালিপ্রবাসী। ছোট মেয়ে আফিয়া প্রায়ই বাড়িতে বিড়াল পোষার বায়না ধরে। নিজেরও ইচ্ছে হয়। কিন্তু মেয়েদের পাশাপাশি বিড়াল পোষা ঝক্কিঝামেলা। মেয়ের আবদার তাই মেটে না। এরই মধ্যে একদিন ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছেন জাহানারা। গ্রীষ্মের দুপুরে আকাশ কালো মেঘ জমেছে। ঝোড়ো বাতাস যেন সবকিছু উড়িয়ে নিতে চায়। লোকজন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। তখনই একটি বাড়ির কার্নিশে আটকা পড়া বিড়ালছানা চোখে পড়ে জাহানারার। মেয়ের আবদার উপেক্ষা করতে পারলেও বিড়ালের মায়া আর উপেক্ষা করা যায়নি বিড়ালছানাটিকে সঙ্গে করে বাড়ি ফেরেন। নাম দেন হান্টার। এরপর মা মেয়েদের পাশাপাশি পরিবারের আরেক সদস্য হয়ে ওঠে হান্টার। এর পর থেকে যখনই কোনো অসুস্থ বিপদগ্রস্ত বিড়াল চোখে পড়েছে, মা–মেয়েরা নির্দ্বিধায় তাদের বুকে জড়িয়েছেন। চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেছেন। পথের বেওয়ারিশ বিড়ালদের খাবার খাইয়েছেন। কারও বিড়াল অসুস্থ হলে ছুটে গিয়ে সারিয়ে তুলেছেন। বিড়ালের প্রতি এই অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে প্রতিবেশী ও স্বজনদের কাছে হয়ে উঠেছেন বিড়ালের মা।
‘আবেগ নয়, দায়িত্ব’
মায়ায় পড়ে বিড়াল পোষা শুরু করলেও জাহানারার কাছে এখন তা দায়িত্ব মনে হয়। তিনি মনে করেন, মানুষ হিসেবে কিছু দায়িত্ব রয়েছে। তার একটি হলো সমাজের অন্য প্রাণীদের প্রতি নির্দয় না হওয়া। সেই দায়িত্ব হিসেবেই তিনি বিড়াল পোষেন। জাহানারা বলেন, ‘শখ থেকে বিড়াল পুষলে এমন অসুস্থ বেওয়ারিশ বিড়ালদের পোষার প্রয়োজন ছিল না। বিদেশি বহু বিড়াল পোষা যেত। এটা মানুষ হিসেবে আমার দায়িত্ব মনে করি। ওরা (বিড়াল) অসহায়। এই শহরের মানুষ তার খাবারের উচ্ছিষ্টটুকুও এখন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মাধ্যমে দূরে নিয়ে ফেলে। শহরের কুকুর–বিড়ালগুলো কোথাও খাবার পায় না৷ ওরা এ বাড়ি–ও বাড়ি ও দোকানপাটে যায় খাবারের জন্য। মানুষ তো খাবার দেয়ই না, উল্টো মারধর করে হাত–পা ভেঙে দেয়। এরপর অভুক্ত বিড়ালেরা পথেই মরে পড়ে থাকে।’
জাহানারা জানান, বিড়াল পোষার কারণে অনেকের কটু কথা শুনেছেন তিনি, লোকজন পাগল বলেছে। আবার অনেকেই কাজটি ভালো চোখে দেখেছেন। তবে স্বামী ও সন্তানদের পাশে পেয়েছেন সব সময়।
মাসে খরচ লাখ টাকার বেশি
৮০টি বিড়াল দেখভালের জন্য আনোয়ার হোসেন ও রাশেদা বেগম নামে দুজন সহকারী রেখেছেন জাহানারা। বিড়ালের খাবার হিসেবে বাজারের ‘ক্যাট ফুড’ ছাড়াও দেন সেদ্ধ ভাত, মাংস ও মাছ। এ ছাড়া প্রতিদিন বেলা ১১টায় এলাকার ৩৫টি বেওয়ারিশ বিড়ালকে খাবার দেন জাহানারা। কারও বিড়াল অসুস্থ হলে নিজের টাকায় চিকিৎসা করেন, খাবার কিনে দেন। সরকারিভাবে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে হয়। এসব করতে গিয়ে মাসে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ হয় তাঁর।
জাহানারা বলেন, ‘আমার বড় মেয়ে আমেরিকায় পড়াশোনা শেষে এখন মাইক্রোসফটে কাজ করে। ছোট মেয়েও আমেরিকায় পড়াশোনা করে। একসময় আমার স্বামী টাকা দিতেন, গত আগস্টে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এখন মেয়েরা টাকা দেয়। আমিও একসময় শিক্ষকতা ও ব্যবসা করেছি। এভাবেই ওদের জন্য টাকার বন্দোবস্ত হয়ে যায়।’
যে কারণে দত্তক দেওয়া
জাহানারা ও তাঁর বিড়ালদের গল্প শুনতে শুনতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়। গল্প বলার ফাঁকে মুঠোফোনে আসতে থাকা একের পর এক ফোন কলে সাড়া দেন। মুঠোফোনে বিড়াল দত্তক নেওয়ার শর্তের কথা জানান। বিড়াল নিতে হলে বাসা ক্যাটপ্রুফ (বাসা থেকে যেন বিড়াল না বের হতে পারে) হতে হবে। ওরা যেন একাকিত্বে না ভোগে, সে জন্য একসঙ্গে দুটি নিতে হবে। ওদের লালন–পালনের জন্য আর্থিক ও মানসিক সামর্থ্য থাকতে হবে। আরও কত কি। এত এত শর্তের কারণ জানতে চাইলে জাহানারা বলেন, ‘ওরা তো আমার সন্তান। যার–তার কাছে তো দিতে পারি না। এমন না যে আর্থিক অভাবের কারণে দিচ্ছি। মেয়েদের কাছে আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। ওদের বাসা, দেখভালের জন্য লোক—সবই থাকবে। কিন্তু ওরা তো মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হবে। তাই ভালো পরিবার দেখে দত্তক দিচ্ছি। মাঝেমধ্যে যেন ওদের দেখে যেতে পারি, সে জন্য ঢাকা–নারায়ণগঞ্জের বাইরে কাউকে দিচ্ছি না।’
বলতে বলতে জাহানারার দুই চোখ জলে ভরে ওঠে। জাহানারা তাঁর সন্তানতুল্য বিড়ালগুলোর দিকে তাকান। বলেন, মানুষের সমাজে প্রাণীগুলো দিন দিন আরও অসহায় হয়ে যাচ্ছে। ওরা কান্না করলে কেউ বোঝে না। মানুষ বিপদগ্রস্ত হলে কেউ না কেউ পাশে দাঁড়ায়। ওদের পাশেও দাঁড়ানো প্রয়োজন।