এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় অনেক পণ্য নতুন পণ্যের আগমনের পর হারিয়ে যায়। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছে ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ফোন। আজ থেকে দেড় দশক বা ১৫ বছর আগেও হাতে একটি ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ফোন থাকার চেয়ে বেশি মর্যাদাকর কিছু ছিল না বলেই অনেক মানুষ মনে করতেন। অথচ আজ এই প্রজন্মের অনেক তরুণ–তরুণী হয়তো ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ফোনের নামও শোনেননি।
ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ফোন দিয়েই স্মার্টফোনের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
লেডি গাগা তখন নিজের ব্ল্যাকবেরি থেকে টুইট করতেন; আরেক বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ম্যাডোনা বালিশের নিচে ব্ল্যাকবেরি ফোন নিয়ে ঘুমাতেন। কিম কার্ডাশিয়ানের তিনটি ব্ল্যাকবেরি ফোন ছিল। বারাক ওবামা যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন নিজের ব্ল্যাকবেরি ফোন সেটটি সঙ্গে রাখার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছেন। ২০০৬ সালে মডেল নাওমি ক্যাম্পবেল নিজের গৃহকর্মীর ওপর মেজাজ হারালে ব্ল্যাকবেরি ফোন ছুড়ে মেরেছিলেন।
দ্য গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, এসব কথা মোটেও অতিকথন নয়, তখনকার বাস্তবতা এ রকমই ছিল। সবখানেই ব্ল্যাকবেরি ফোন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনি শেষ কবে ব্ল্যাকবেরি ফোনের কথা ভেবেছেন; আজ থেকে এক বছর আগে, নাকি এক দশক আগে, নাকি তারও আগে। এখনকার সংস্কৃতিতে ব্ল্যাকবেরি ফোন প্রকৃত অর্থে অদ্ভুত জায়গা নিয়ে আছে। অথচ এই ব্ল্যাকবেরি ফোন একসময় তুমুল গতিতে বাস্তবতা বদলে দিয়েছিল।
এই ফোন দিয়ে ইমেইল করা যেত, ফলে মানুষ তখন অফিসের ধরাবাধা সময়ের জাঁতাকল থেকে মুক্তি পায়; কিন্তু অ্যাপল আইফোনের ঘোষণা দেওয়ার পরপর এই ফোন ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। ব্ল্যাকবেরি ফোনের উত্থান আর পতন এত দ্রুত ও প্রবল গতিতে হয়েছে যে আজ তা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য—বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব।
তবে সৌভাগ্যের কথা হলো, ব্ল্যাকবেরির উত্থান–পতনের গল্প নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। লুজিং দ্য সিগন্যাল: দ্য আনটোল্ড স্টোর বিহাইন্ড দ্য এক্সট্রা অর্ডিনারি রাইজ অ্যান্ড স্পেকটাকুলার ফল অব ব্ল্যাকবেরি শিরোনামের বইয়ের ওপর ভিত্তি করে এই ছবি তৈরি করা হয়েছে।
এ সিনেমায় দেখানো হয়েছে, কীভাবে দুজন কানাডীয় বিজ্ঞানী মাইক ল্যাজারিডিস ও ডগলাস ফ্রেইন বিশ্বের প্রথম স্মার্টফোন উদ্ভাবন করেন এবং বিনিয়োগকারী জিম বালসিলির সহযোগিতায় এই ফোন বাজারে নিয়ে আসেন। তাঁরা যেন রকেট যানে চেপে সোজা চাঁদে চলে গিয়েছিলেন এবং তারপর উল্কার গতিতে পতন। এখন তো বাস্তব জীবনের অনেক পণ্য নিয়েই ছবি তৈরি হচ্ছে, ভিডিও গেমস থেকে শুরু করে জুতা। ব্ল্যাকবেরি ছবিটি এগুলোর মধ্যে অন্যতম উপভোগ্য।
এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ইতিহাসেরও কিছুটা পুনর্লিখন হতে পারে। আজকের বিবেচনায় ব্ল্যাকবেরিকে একদম শতভাগ ব্যর্থ এমন আখ্যা দিয়ে বাতিল করা যেতে পারে। অন্য অনেক কোম্পানির মতো ব্ল্যাকবেরিও মোবাইল ফোন জগতের পরিবর্তনশীল বাস্তবতা বুঝতে পারেনি, যেমন নিজেদের জায়গায় তা ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি ব্লকবাস্টার ভিডিও ও ফ্রেন্ডস রিইউনাইটেড।
তবে এই ছবিতে দেখানো হয়েছে, ব্ল্যাকবেরির একসময় সবই ছিল। এতে দেখানো হয়েছে, মানুষ কখন ব্ল্যাকবেরির সক্ষমতা বা শক্তি সম্পর্কে বুঝতে পারল। এরপর তাদের পৃথিবীও সেভাবে বদলে গেল। প্রযুক্তিবিষয়ক লেখক জোনাথন মার্গোলিস দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘নিউইয়র্কে একটি বই লেখার কাজ করছিলাম; তখন দেখলাম, সবার কাছেই এই ব্ল্যাকবেরি জিনিসটা আছে। মানুষ আমাকে বলছিল, এই ফোন থেকে ই–মেইল করা যায়।’ তখন তাঁর ঠিক কী মনে হয়েছিল তা–ও তিনি মনে করতে পারেন, ‘না, সে নিশ্চয়ই ভুল বলছে, সে হয়তো এসএমএস পাঠাচ্ছে। কিন্তু এরপর আমার এক বন্ধু সেই ফোন থেকে মেইল করলে আমি দৌড়ে বাসায় গিয়ে কম্পিউটার চালু করে দেখি, সেই মেইল এসেছে।’
এটাই সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল বলে দ্য গার্ডিয়ান–এর সংবাদে বলা হয়েছে। ব্ল্যাকবেরি ও পরবর্তীকালের স্মার্টফোন মানুষের কাজের ধরন বদলে দিয়েছে। ব্ল্যাকবেরি বা স্মার্টফোন থাকার অর্থ হলো, জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকতে কাউকে এখন আর অফিসের সারি সারি বাতির আলোয় ডেস্কে মুখ গুঁজে বসে থাকতে হবে না। সেই স্বাধীনতা মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এল। তখন মানুষ চাইলে রাতের বেলায় যেমন ই–মেইল পাঠাতে পারে; তেমনি রাতের বেলায় বা ছুটির দিনে বা এমনকি টয়লেটে বসে ই–মেইলের উত্তর দিতে পারে বা তা পাঠাতে পারে।
এখনকার দিনে বিষয়টা একদম সাদামাটা হলেও তখন তা রীতিমতো দেখনদারির বিষয় ছিল। কারও হাতে ব্ল্যাকবেরি ফোন থাকার অর্থ হলো, তিনি ব্যস্ত মানুষ। অর্থাৎ মানুষ তাঁকে খুঁজছে। মানুষ যখন–তখন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। তিনিও ব্ল্যাকবেরির কল্যাণে যখন–তখন উত্তর দিতে পারেন।
কিন্তু এই উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বিশ্লেষকেরা বলেন, অত্যধিক আত্মবিশ্বাস বা গর্ব ব্ল্যাকবেরির জন্য কাল হয়েছে। একসময় তা গণ্ডির মধ্যে আটকে যায়। একসময় ব্ল্যাকবেরি মনে করত, মানুষ চ্যাপ্টা বোতামহীন পর্দায় টাইপ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না; কিন্তু বাস্তবে উল্টো ব্যাপার ঘটল, কিছুদিনের মধ্যেই খটাখট শব্দ তুলে ব্ল্যাকবেরির কিপ্যাডে টাইপ করা প্রাচীন হয়ে যায়।
ফলাফল—ব্ল্যাকবেরি এখন কার্যত মৃত। ২০১৬ সালের পর তারা আর কোনো ফোন উৎপাদন করেনি। একই বছর সেলিব্রিটি ব্ল্যাকবেরি সাইটিংস শীর্ষক ফটো ব্লগ বন্ধ হয়ে যায় এই বার্তা দিয়ে: ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সব সেলিব্রিটির এখন আইফোন আছে, বিষয়টি খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’ এরপর গত জানুয়ারি মাসে ব্ল্যাকবেরি কোম্পানি সব সেবা বন্ধ করে দেয়, যদিও অনেক ভক্ত এখনো সেই বাস্তবতা মানতে চান না।
বিশ্লেষকেরা বলেন, ব্ল্যাকবেরির বেলায় যা ঘটেছে, তা ইতিহাসের প্রথম বা শেষ ঘটনা নয়। মানুষের রুচি প্রায়ই পরিবর্তনশীল। ফলে এমন দিনও আসতে পারে, যখন আইফোন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিষয়টি কেবল নতুন আরেকটি ব্র্যান্ডের আগমনের অপেক্ষা মাত্র।