চলার গতি, কাজের গতি, বলার গতি সকলেই সমস্বরে বলতে থাকে ‘গতি বাড়াতে’, আর তেমন অনুজ্ঞা শুনতে ভালোই লাগে। তবে মজার বিষয় হলো, প্রশ্নটি মনের মধ্যে নিয়ত পাক খেতে থাকে, গতি বাড়িয়ে যাবে কোথা, গন্তব্যের শেষ সীমা বা লক্ষ্যবিন্দুটি তাহলে কি? তা দোযখের প্রতি যদি ধেয়ে যায় তবে তেমন ক্ষেত্রে গতি মন্থর হলে কিছুটা জ্বালা–যন্ত্রনার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, আবার গতি যদি বেহেশতিমূখি হয় তবে যতদ্রুত ছুটে যাওয়া সম্ভব ততই মঙ্গল!
আপনি চলছেন দ্রুতযানে, দ্রুত পৌছে যাচ্ছেন, আর একজন সাধারণ গাড়িতে ধিরগতিতে যাচ্ছে এগিয়ে; প্রশ্নটি হলো আপনাদের গন্তব্য কোথা তা তো বলেন নি। মানুষের কথায় বলুন আর প্রাণী জগতের কথা বলুন, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে চলার গতি নির্ভর করে পথের প্রান্তে লক্ষ্যবিন্দু বা গন্তব্যস্থল। প্রত্যাশিত ফল লাভে যদি থাকে সুনিশ্চিত সম্ভাবনা, তবে কারো বলে দেবার প্রয়োজন পড়ে না গতি বাড়ানোর বিষয়ে। ঘরে যদি থাকে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, তবে স্বামীর গৃহাভিমূখী গতি সর্বদাই একু বেগময় থাকে, আর ঐ একই ব্যক্তিকে যদি কার্যোপলক্ষ্যে বহির্মূখীযাত্রা করতে হয় তখন দেখা যায় গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। তাহলে দেখা যায় গতি ওঠা নামা করে লক্ষ্যবিন্দুর উপর ভিত্তি করে বা তার আকর্ষণে।
মানুষ নিয়ত ছুটে চলে, তা ভাববেন না যে তারা কেবল ছোটাছুটির স্বার্থেই তেমন করছে, আসলে তা নয়, ব্যক্তির হৃদয়–মন জুড়ে রয়েছে সুনিশ্চিত কাঙ্খিত প্রাপ্তির প্রত্যাশা যা হৃদয়াভ্যন্তরে থেকে তাকে নিয়ত প্রেষণা প্রেরণা দিয়ে চলছে, থেমে থাকার তার উপায় নেই। ব্যক্তি দিবানিশি স্বপ্ন দেখে। আর প্রকৃত স্বপ্ন তো হবে সেই স্বপ্ন যা তাকে ঘুমোতে দেয় না। মানুষ ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখে তা আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন নয়, যতোটা গুরুত্বপূর্ণ সেই স্বপ্ন যা তাকে ঘুমোতে দেয় না, স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত। গুরুজনদের দায়িত্ব হওয়া উচিৎ সন্তানদের পথ চলার শেষ প্রান্ত অর্থাৎ লক্ষ্যবিন্দুর দিকে। যেমন শিক্ষানবীশ কোন বিষয়ে পড়াশুনা করছে, আর তার শ্রমের ফসল কি হতে পারে, সে দিকে অভিভাবক নজর রাখবে, এটাই হলো সুস্থ্য প্রত্যাশা। সুশিক্ষিত হয়ে সন্তানটি যদি একটা মাতাল খুনি সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে, তবে বোধ করি সকল অভিভাবক বৃন্দের মনস্তাপের কারণ হবে নিশ্চয়। তেমন পিতা–মাতা সমাজে মুখ দেখাতে চাইবে না। আবার কোনো পিতা–মাতার সন্তান যখন শুভ কাজে উন্নতির চূড়ায় পৌছাতে পারে, তখন তারা স্বগর্বে সকলকে ডেকে ডেকে দেখাতে থাকে, ঐ যে উপরে চড়ে আছে, ওটিই আমাদের সন্তান, যেন ঈদের চাঁদ দেখানোর মত দীর্ঘ প্রত্যাশিত কোনোকিছু। তাই বলছি গতি বাড়ানোর দিকে যতোটা নজর দিবেন, তার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে পথের শেষ প্রান্তের অবস্থানের বিষয় নিয়ে।
যে মতাদর্শ শুরুই হলো খুন, রাহাজানি, লুটতরাজের মাধ্যমে এবং উক্ত মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা পাবার পরে নগর–জনপদ কচুকাটা হলো, হলো ভষ্মিভুত, আর তেমন অশুভ ঢেউ আজতক পুরো সমাজটাকে তটস্থ অস্থির করে রেখেছে তা প্রকাশ প্রচার না হওয়াই উত্তম মনে করি। মানব কল্যাণ সাধনকল্পে যারা রয়েছেন নিবেদিত প্রাণ, আজ তাদের মনোবল বাড়ানো ও হৃদয়ে উৎসাহ প্রদান করা হবে শুভ কাজে শরিক হওয়ার সমতুল্য।
হ্যা, গতি বাড়াতে হবে শুভ কাজে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দুতে পৌছানোর স্বার্থে বিশ্ব আজ বড়ই অশান্ত, মনে হয় তাতানো খোলা, ফুটন্ত তেল, মাত্র একফোটা জল পড়ার সাথে সাথে ক্ষেপে ওঠে, যেমন বারুদের ভান্ডার, আগুনের ক্ষুদ্র একটি স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট, বিশাল বিষ্ফোরন ঘটাতে। তাই বলছি, মানবতাহীন ভুল শিক্ষার ফলে সমাজটি আজ বারুদের মতো বিস্ফোরণ মুখর হয়ে উঠেছে, আর তা একদিনে গড়ে ওঠা বা অমন পর্যায়ে আসতে পারে নি নিশ্চয়। মানুষের জন্ম ও খোদার ভুমিকা নিয়ে পাঠদানের সময় ছেলে পুলেরা হতবাক হয়ে গেল, তাদের ধারণা ছিল, খোদা কেবল মুসলমানদের সৃষ্টি ও তদারকি করে থাকেন, অন্য কোনো জাতিকে তিনি প্রেম করেন না। এ ধারণাটি ছেলেবেলা আমার মধ্যেও পুঞ্জিভুত ছিল। পড়াশুনার ফলে আজ বুঝতে পারি, খোদা মাত্র একজন, আর তিনি মাত্র একজন মানুষ (আদম) সৃষ্টি করে তাঁকে প্রচুর আশির্বাদ করেছেন, করেছেন ক্ষমতাধর, প্রজাবন্ত ও বহুবংশে পরিণত হবার জন্য।
বর্তমান বিশ্বে যতগুলো বিভক্তি ও ভেদাভেদ দৃষ্ট হচ্ছে, সবগুলো বিভ্রান্তির কুফল। অবশ্য বিভ্রান্তির কারণেই অর্থাৎ কুলটা ইবলিসের প্রতারণা বুঝতে না পারার কারণে আদম হাওয়া নিশিদ্ধ কাজ করে খোদার বিরাগভাজন হয়ে পড়লেন। আমরা তার ফল উপভোগ করে ফিরছি দিবানিশি।
আল্লাহ হলেন প্রেমের পারাবার। মহব্বতের কারণেই স্বীয় সুরতে তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। যদিও মানুষ খোদার অবাধ্য হয়ে নিজেদের উপর অভিশাপ ডেকে আনলো, তথাপি মানুষের এহেন করুন হালত দেখে করুণানিধি প্রেমকাতর হলেন, কথায় বলে মধুর মধ্যে হলাহল থাকতে পারে না, যেমন আলোর মধ্যে আঁধারের স্থান থাকতে পারে না, তেমন প্রশ্নই জাগে না, তাই মানবজাতিকে বাঁচাবার জন্য চূড়ান্ত মূল্যে এক বিশেষ ব্যবস্থা প্রেরণ করলেন, আর উক্ত ব্যবস্থা বা প্রেমপত্র পূতপবিত্র খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহ, যার মধ্যে নেই কোনো পাপ, না আছে হিংস্রতা। সীমাহিন প্রেমের তাগিদে গোটা অপরাধি বিশ্বকে মুক্তপাপ করার জন্য তিনি নিজ পূতপবিত্র প্রাণ দিলেন কোরবানি। তিনি ক্ষণিকের জন্য মানুষকে মহব্বত করেন নি তথা আত্মত্যাগ করেন নি, বরং মানুষকে অনন্ত জীবন অর্থাৎ শাশ্বত্ব জীবন দান ও খোদার সাথে অনন্ত জীবনের এক মধুময় সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যই তার স্বীয় প্রাণের কোরবানি।
মসিহের মাধ্যমে বাতেনি খোদার সম্পূর্ণ ও হুবহু পরিচয় আমরা জানতে পেরেছি। তিনি মহব্বত, আর মহব্বতের মধ্যে কোনো ভন্ডামির স্থান নেই, প্রকৃত খাঁটি মহব্বত ভয় দূরে করে দেয় এবং কেবল মহব্বত শত অপরাধ ক্ষমা করে দিতে শক্তি ও প্রেরণা যোগায়। বিশ্বাস, আশা ও মহব্বত এ শুকুমার গুণগুলোর মধ্যে কেবল মহব্বত থাকবে চিরকাল।
মসিহ হলেন ঐশি নূর। সূর্য যেমন পৃথিবীকে আলোকিত করে রাখে, মসিহ তেমনই প্রত্যেকটি ব্যক্তির হৃদয় খোদার নূরে উজ্জ্বল ও আলোকিত করে রাখেন। যার মধ্যে মসিহের আত্মা বা পাকরূহ বাস করে না, তার মধ্যে ঐশি প্রেম বিরাজ করতে পারে না, কেননা প্রেমের আঁধার একমাত্র মসিহ, যিনি হলেন বাতেনি খোদার হুবহু জাহেরী দৃষ্টান্ত। মসিহের দাবি তাই যথার্থ, যে কেহ মসিহকে দেখার সুযোগ পেয়েছে, সেই খোদাকে দর্শন করার সৌভাগ্য লাভ করেছে। কেননা খোদা আর মসিহ একই অবস্থানে থাকেন। মসিহ তো খোদার জীবন্ত কালাম, যে কারণে তাঁর উপাধি হলো ‘কালেমাতুল্লাহ’ আর তাঁকে ‘রুহুল্লাহ’ বলেও ডাকা হয়, তার কারণ হলো, আল্লাহ স্বীয় পবিত্র রূহ কুমারি মরিয়মের গর্ভে ফুঁকে দিলেন আর মসিহের জন্ম হলো। তাছাড়া তিনি মানুষের শারীরিক মানসিক রোগব্যধি নিরাময় করার ক্ষমতায় ছিলেন পারঙ্গম, এমন কি মৃতকে পর্যন্ত জীবিত করার ক্ষমতা হলেন তিনি পরিপূর্ণ। তিনি তো জগতে খোদার পক্ষেই হলেন আবির্ভূত। কোনো পার্থিব স্বার্থের কারণে তিনি রাজত্ব বা রেসালত প্রতিষ্ঠা করেন নি, যা করতে গিয়ে মানুষ কচুকাটা করতে হয়।
আজ আমরা সকলে সুরক্ষিত কেবল খোদার এক বিশেষ রহমতে, আর এই রহমত পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছে খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহের মাধ্যমে। তিনি সম্পূর্ণ সত্য, ন্যায় ও জীবন। তিনিই হলেন দূনিয়ার নূর তাই অন্ধকারের কুঠুরী ত্যাগ করে দ্রুত নূরের রাজ্য ছুটে যাবার গতি হবে ফলপ্রসু গতি, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দুতে পৌছার গতি, তা দ্রুতযানে চড়ে যেতে পারলে অতি উত্তম।