প্রতিদিনই সড়কে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। এই ঘটনাগুলোকে শুধুই দুর্ঘটনা বলে পত্রিকার পাতায় খবর ছাপা হচ্ছে। এরপর আর কেউ খোঁজ নিচ্ছেন না, কেন এই দুর্ঘটনা? দায় কার? দুই–একটি আলোচিত ঘটনায় তদন্ত ও মামলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে সড়কে প্রাণ হারানো ব্যক্তির স্বজন বা আহত ব্যক্তি আইনানুগ কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। পাচ্ছে না যথাযথ ক্ষতিপূরণও। সর্বশেষ শনিবার ঝালকাঠিতে বাস পুকুরে পড়ে ১৭ জন নিহতের ঘটনায় প্রায় ৩০ ঘণ্টা পার হলেও গতকাল রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। বাসটির চালক বা হেলপার কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি পুলিশ।
*শুধুই দুর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই *পরিবহন খাতের ৮৬ শতাংশ শ্রমিক
*দৈনিক ১৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন, ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সাপ্তাহিক ছুটি নেই
ঝালকাঠি পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, দুর্ঘটনার পর থেকেই বাশার স্মৃতি পরিবহনের বাসটির চালক ও হেলপার পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে জানিয়ে জেলা পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, দুর্ঘটনার কারণ ও সংশ্লিষ্ট সবার গাফিলতির বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দ্রুতই এই ঘটনায় মামলা হবে।
শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজের (বিলস) এক গবেষণা বলছে, পরিবহন খাতের ৮৬ শতাংশ শ্রমিক দৈনিক ১৩ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। এই খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। চালকরা বেপরোয়া গতির পাশাপাশি অনেক সময় মোবাইল ফোন কানে নিয়েও গাড়ি চালান।
গত মার্চে মাদারীপুরের কুতুবপুরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে থেকে ছিটকেপড়া ইমাদ পরিবহনের বাসটির দুর্ঘটনার তিনটি কারণ তখন শনাক্ত করেছিল তদন্ত কমিটি। চালক চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তিনি ক্লান্ত ছিলেন, গাড়িটি চলছিল অস্বাভাবিক গতিতে। ঐ সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার হলেও বাসটি চালানো হচ্ছিল ১২০ কিলোমিটার গতিতে। বাসটির ফিটনেস এবং রুট পারমিট কোনোটিই ছিল না। তবে চালকেরও লাইসেন্স ছিল না।
বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই চালকদের দায়ী করা হয়। কিন্তু এর পেছনে কী কারণ আছে তা দেখা হয় না। চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ড করা হয়েছে। তাদের নিয়োগপত্র দেওয়ার আইন আছে। কিন্তু সেগুলো মানা হয় না। চালকদের কোনো নিয়োগপত্র নেই, নির্ধারিত বেতন নেই। তাদের ট্রিপভিত্তিক মজুরি দেওয়া হয়। তাই তারা বিশ্রাম না নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালাতে বাধ্য হন। বেশি ট্রিপ পাওয়ার আশায় নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে গাড়ি চালান। এমনও হয় আট ঘণ্টার একটি ট্রিপ দিয়ে এক ঘণ্টা বা তার কম সময় বিশ্রাম নিয়ে তারা আরেকটি ট্রিপ শুরু করতে বাধ্য হন। একজন চালকের ২৪ ঘণ্টায় এক নাগাড়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানোর আইন আছে। দূর পাল্লার একটি বাসে তাই দুই জন ড্রাইভার রাখার নিয়ম। কিন্তু কোনো বাসেই দুই জন ড্রাইভার নাই। এমন ব্যবস্থা করারও সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সাধারণভাবে চালকদের সড়ক দুর্ঘটনার জন্য প্রধানভাবে দায়ী করা হলেও আমরা গবেষণায় দেখেছি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য চালকদের দায় চার নম্বরে। এক নম্বরে অব্যবস্থাপনা তার পরে আছে গাড়ির ফিটনেস। তার পরে সড়ক ব্যবস্থা। দূর পাল্লার বড় বড় কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি ছাড়া অন্যদের গাড়ির কোনো ফিটনেস ও রুট পারমিট নাই। তিনি বলেন, আসলে এসবের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান করা হলেও এগুলো চলে সমঝোতার ভিত্তিতে। মালিকপক্ষ এতই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যায় না। তবে এগুলোকে শুধু দুর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে সঠিক বিচার হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, বাংলাদেশে বাস–মিনিবাস রয়েছে ৮০ হাজার। সব ধরনের যান্ত্রিক যানবাহন মিলিয়ে এর সংখ্যা ৫৭ লাখ। সিটি সার্ভিসের বাস–মিনিবাসের ৬০ ভাগেরই কোনো ফিটনেস নাই। আর দূর পাল্লার বাসের ৩০ ভাগের ফিটনেস নাই। বাংলাদেশে বাস–মিনিবাসের বৈধ লাইসেন্সধারী ড্রাইভার আছে ৪০ হাজার। তাই বাস–মিনিবাসে ভুয়া বা লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারদের দৌরাত্ম্য। এখানে মালিক পক্ষের দায় আছে, দায় আছে বিআরটিএর। তবে সমস্যা হলো পুরো গণপরিবহন খাতের শতকরা এক ভাগেরও কম সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাই বেসরকারি মালিকরা এই খাত নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্ল্যাহ দাবি করেন, মালিক সমিতি সব সময়ই রুট পারমিট ও ফিটনেসহীন গাড়ির বিপক্ষে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশকে বলে আসছি। তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন? আমরা কীভাবে জানব কোনো গাড়ির ফিটনেস আছে বা কোন গাড়ির নেই? কোন গাড়ির রুট পারমিট আছে কোন গাড়ির নেই? বাংলাদেশে বাস–মিনিবাসসহ সবধরনের যান্ত্রিক যানবাহন আছে ৬০ লাখের বেশি। চালক আছে ৪০ লাখ। ড্রাইভারই তো নেই। দক্ষ–অদক্ষ তো পরের কথা। আর ড্রাইভারেরাই মাসিক বেতন ও নিয়োগপত্র নিতে চান না। তারা চার দিন কাজ করে তিন দিন বাড়ি চলে যান। অনেকের তো ঠিকানাই ঠিক নাই। কাকে নিয়োগপত্র দেব?
প্রসঙ্গত, গত ছয় মাসে সারা দেশে ২ হাজার ৭৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৮৯৮ জন নিহত ও ৪ হাজার ৭২০ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে ১ হাজার ৩০২টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪৮৪ জন নিহত ও ২ হাজার ৪৮৫ জন আহত হয়। এছাড়া শুধু গত জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫১৩ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে আরো ৮২৬ জন। এদিকে গত ছয় মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৪৫৫ শিশু নিহত হয়েছে। শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়।