‘পৃথিবীতে কীভাবে বাঁচতে হয় বাবা তা বলেন না, তিনি সারা জীবন পরিবার, সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকেন। আর সন্তানদের দেখার সুযোগ করে দেন—কীভাবে বাঁচতে হয়।’ (প্রবাদ)
পৃথিবীতে চোখ মেলে মাকে আঁকড়ে ধরেই বেড়ে ওঠে একটি শিশু। মায়ের স্নেহছায়ায় বড় হয় সন্তান। বাবা যেন দূরবর্তী দ্বীপের মতো। আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজব্যবস্থায় বাবা খানিকটা দূরের মানুষ। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকেন পরিবারের ঘেরাটোপের বাইরে। তার সান্নিধ্য খুব কমই পায় সন্তানরা। সারা দিন কাজে ব্যস্ত থাকা মানুষটি পরিবারকে সেভাবে সময় দিতে পারেন না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানরা বাবার অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে থাকেন। বুঝতে পারে একজন মানুষ নিজেকে পুড়িয়ে সংসারকে আগলে রেখে চলেছেন। যিনি কখনোই তার সন্তানকে বলেন না যে, তিনি তাদের ভালোবাসেন। বরং দেখিয়ে দেন যে, তিনি তাদের ভালোবাসেন।
আবার এমনও বলা হয়ে থাকে, মা জন্ম দিয়েই মা। কিন্তু বাবা হয়ে উঠতে হয়। বাবা তার জীবন দিয়ে, কর্ম দিয়ে সন্তানদের মনে ঠাঁই করে নেন।
বাবাকে নিয়ে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বলেছেন ‘নিজের অস্তিত্বে বাবার অবয়ব ফুটে উঠতে থাকে বলেই মানুষ ক্রমেই বড় হতে থাকে।’ বাবা অনুচ্চারিত প্রতিজ্ঞায় সন্তানদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেন। বাবাকে ভালোবাসা জানাতে, তার প্রতি সম্মান জানাতে, সংসারের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ব জুড়ে পালিত হয়ে আসছে বাবা দিবস।
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। প্রতি বছরের জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় বাবা দিবস। সে হিসেবে আজ রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইংল্যান্ড, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, ভারতসহ প্রায় ১১১টি দেশে এ দিনেই বাবা দিবস উদযাপন করা হয়। তবে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ সেপ্টেম্বরের প্রথম রবিবার বাবা দিবস পালন করে থাকে।
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও কয়েক বছর ধরে বাবা দিবস পালন শুরু হয়েছে। সন্তানরা শ্রদ্ধার সঙ্গে বাবাকে সম্মান জানান বিভিন্ন উপহার দিয়ে। ভালোবাসার উষ্ণ আবেগে ভাসিয়ে তাকে বলে, ‘বাবা, আমরা তোমার সন্তানরা তোমাকে ভালোবাসি।’
বাবা দিবসের শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। তবে ঠিক কবে থেকে এ দিবসটির প্রচলন হলো তা নিয়ে দ্বিধা আছে। কেউ কেউ বলেন, ১৯০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় চার্চের মাধ্যমে দিনটির প্রচলন। অন্যরা বলেন, ওয়াশিংটনের ভ্যাংকুবারে প্রথম বাবা দিবস পালন করা হয়। তবে সাধারণ মত, বাবা দিবসের প্রবক্তা সোনার স্মার্ট ডোড। ১৮৮২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্ম নেন। তার পিতা উইলিয়াম জেকসন স্মার্ট (১৮৪২–১৯১৯) ছিলেন কৃষক। মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় তিনি বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ডোডের মা অ্যালেন ভিক্টোরিয়া চেক স্মার্টসহ পুরো পরিবার চলে যান ওয়াশিংটনের স্পোকেনে। সেখানেই জন্ম হয় সোনার স্মার্ট ডোডের। যখন তার বয়স ১৬, তখন তার মা ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। পরিবারে সোনারই ছিলেন একমাত্র কন্যা। পূর্ব ওয়াশিংটনের এক গ্রামের ফার্মে এরপর থেকে তিনি নবজাতকসহ পাঁচটি সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব তুলে নেন। সোনারা বড় হওয়ার পর অনুভব করলেন ছয়টি সন্তান একা একা মানুষ করতে কী ভীষণ পরিশ্রমই না তার বাবাকে করতে হয়েছে। উইলিয়াম তার মেয়ের চোখে ছিলেন সাহসী, নিঃস্বার্থ একজন ভালো বাবা, যিনি সন্তানদের জন্য নিজের সব সুখ–শখ, আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিলেন। সোনার স্মার্ট বিয়ে করেন জন ব্রোস ডোডকে। তাদের সন্তান জ্যাক ডোড জন্মের কিছুকাল পরে সোনারের স্বামীও মারা যান। এ অবস্থায় বাবা আর মেয়েতে মিলেই পুরো জীবন পার করে দেন।
বাবার প্রতি সম্মান জানাতে ‘বাবা দিবস’ ঘোষণার বিষয়টি সোনারের চিন্তায় আসে ১৯০৯ সালে। ‘মা দিবস’-এর অনুষ্ঠানে সে বছর চার্চে যান সোনার ডোড। অনুষ্ঠানে এসেই তার মনে হয় মা দিবসের মতো বাবাদের জন্যও একটি দিবস করা প্রয়োজন। যেখানে মায়েদের মতো বাবাদেরও সম্মান জানানো হবে। প্রকাশ করা হবে ভালোবাসা। যুক্তরাষ্ট্রের স্পোকেন মন্ত্রীজোটের কাছে তিনি তার পিতার জন্মদিন ৫ জুনকে বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব পাঠান। তার প্রস্তাবের প্রশংসা করলেও মন্ত্রীজোট ৫ জুনকে বাবা দিবস ঘোষণা করতে রাজি হয়নি। তারা জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে বাবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। একটি স্থানীয় পত্রিকা সেদিন ছুটি ঘোষণা করে এবং বিভিন্ন দোকানিরা বাবাদের জন্য নানা রকমের উপহার সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে রাখেন।
১৯ জুন ১৯১০। প্রথম বাবা দিবস উদযাপিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পোকেনস শহরে। শহরের তরুণ–তরুণীরা দুটি করে গোলাপ নিয়ে যান চার্চে। একটি লাল, অন্যটি সাদা। লাল গোলাপ জীবিত পিতাদের শুভেচ্ছার জন্য, আর সাদা গোলাপ মৃত পিতাদের আত্মার তুষ্টির জন্য। বিষয়টি পুরো মার্কিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সবাই মিলে এই ভাবনার প্রশংসা করেন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে তা শুরু হয়। কিন্তু তারপরও এটাকে জাতীয়ভাবে পালনে কংগ্রেসের নানা দ্বিধা ছিল। কেননা তারা ভাবছিলেন এতে বাবা দিবস একটি বাণিজ্যে পরিণত হতে পারে। ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিষয়টি অনুমোদন করেন। ১৯২৪ সালে প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কোলিজ এটিকে জাতীয় দিবসে রূপ দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন রাষ্ট্রীয়ভাবে জুনের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস উদযাপনের ঘোষণা দেন। অবশেষে ১৯৬৬ সালে ৫৬ বছর পর বাবা দিবসকে জাতীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। সোনারা ডোড মারা যান ১৯৭৮ সালে। তখন তার বয়স ছিল ৯৬ বছর।