তেঁতুলিয়া উপজেলার শারিয়ালজোত এলাকার তরুণ সাঈদ আলী। নিজের বেকারত্ব দূর করতে চার বছর আগে ঋণ নিয়ে বাড়ির পাশে এক একর জমিতে চা বাগান করেছিলেন। হতাশা আর ক্ষোভে নিজের স্বপ্নের চায়ের বাগানের এক একটি গাছ এখন উপড়ে ফেলছেন তিনি। সাঈদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে চা বাগান করে ক্রমাগত লোকসান হচ্ছে আমার। ঋণ করে চা বাগান করেছি। কিন্ত ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না। প্রতি বছর চায়ের ভরা মৌসুম এলেই কারখানা মালিকরা সিন্ডিকেট করে চা পাতার দাম কমিয়ে দেয়। তাদের সিন্ডিকেট কেউ ভাঙতে পারছে না।
প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার দর ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কারখানা মালিক খেয়াল খুশি মতো ১৩ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে চা পাতা কিনছেন। তার মধ্য থেকে ওজন থেকে আবার ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়ে আমাদের দাম দিচ্ছেন। আমরা কেজি প্রতি মাত্র ৬ থেকে ৭ টাকা পাচ্ছি। এই টাকা দিয়ে শ্রমিকদের মজুরিই পরিশোধ করতে পারছি না। কারখানা মালিকরা আমাদের টাকায় প্রতি বছর কারখানার পরিধি বাড়াচ্ছে। আর আমরা ঠকেই চলেছি। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। তাই চা বাগান কেটে ফেলা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিলো না। চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, কারখানা মালিকরা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো দরে চা পাতা কিনছেন। তারা চাষীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছেন। আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক, চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়সহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেছি। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কাঁচা চা পাতার কম দাম ও কর্তন করে দাম দেওয়ার অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। শীঘ্রই চাসংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সাঈদ আলীর মতো একই এলাকার রফিকুল ইসলাম চা পাতা বিক্রি করতে গিয়ে কারখানা মালিকদের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে দুই বিঘা জমির চা বাগান উপড়ে ফেলে বেগুনসহ শাক সবজি চাষ শুরু করেছেন। শুধু সাঈদ ও রফিকুল নয় তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অনেক ক্ষুদ্র চা চাষিদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। তারা ক্রমাগত লোকসানে পড়ে চা বাগান ভেঙে ফেলছেন। কয়েক বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ তিনগুণ বাড়লেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা। চাষিদের অভিযোগ ভরা মৌসুমে কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট, কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, অবৈধভাবে কালো বাজারে চা বিক্রি, নিলাম বাজারে নি¤œমানের চা সরবরাহ, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দুর্বল মনিটরিং ছাড়াও বিভিন্ন কারণে পঞ্চগড়ের ব্যাপক সম্ভাবনাময়ী সমতলের চা শিল্প বর্তমানে হুমকিতে পড়েছেন বলে জানান চাষীরা। ২০০০ সালে প্রান্তিক জেলা পঞ্চগড়ের সমতলে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের গোড়াপত্তন হয়। দুই দশকেই চা চাষের বিপ্লব ঘটে জেলাটিতে। চা উৎপাদনে এরই মধ্যে দ্বিতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পঞ্চগড়। প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠেছে ছোট বড় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার চা বাগান। বর্তমানে জেলায় ২৩টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু রয়েছে।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুতে কারখানা কম থাকলেও প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩৮ টাকা কেজি পর্যন্ত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চলছে কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট। চায়ের দাম ১৮ টাকার ওপরে উঠতে পারেনি। সর্বশেষ কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি প্রতি কেজির সর্বনি¤œ দর নির্ধারণ করে ১৮ টাকা। চলতি চা মৌসুমের শুরুতে ১ মার্চ এই দরেই পাতা কিনেছে কারখানা মালিকরা। মে জুন জুলাই এই তিন মাসকে বলা হয় সমতলের চায়ের ভরা মৌসুম। এই সময়েই সব কারখানা মালিকরা সিন্ডিকেট গড়ে কায়দা করে দাম কমিয়ে দেয়। চা পাতার চাপ বাড়ানোর জন্য একেক দিন একেক কারখানা বন্ধ রাখা হয়। আর চাপ বাড়লেই কমিয়ে দেওয়া হয় দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি চা পাতা ১৩ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে কিনছেন তারা। তার সঙ্গে আবার মোট ওজন থেকে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চাষিরা কেজি প্রতি পাচ্ছেন মাত্র ৬ থেকে ৭ টাকা। অথচ প্রতি কেজি চা পাতা উৎপাদন করতে তাদের খরচ পড়ছে ১৫ থেকে ১৮ টাকা। কেজি প্রতি তাদের লোকসান গুণতে হচ্ছে ১০ টাকারও বেশি।
আর অন্যদিকে চাষিদের কাছ থেকে কম দামে এবং ওজন বাদ দিয়ে নেওয়া চা থেকে দৈনিক কোটি টাকা ঢুকছে কারখানা মালিকদের পকেটে। প্রতি বছর প্রতিটি কারখানার পরিধি বাড়ছে। এমনকি অনেক কারখানা মালিক চাষিদের কাছ থেকে বাগান কিনে নিচ্ছেন। সমতলের হাজার হাজার ক্ষুদ্র চা চাষিদের ঘামঝরা চা চাষে পকেট ভরছে কারখানা মালিকদের। এছাড়া ভালো তৈরি চা অবৈধভাবে কালোবাজারে বিক্রি আর নি¤œ মানের চা পাতা নিলাম বাজারে সরবরাহের অভিযোগও রয়েছে কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে। এদিকে ভরা মৌসুমে চায়ের এই সংকট চলছে গত কয়েক বছর ধরে। জেলা প্রশাসন টাস্ক ফোর্স গঠন, মনিটরিং টিম গঠন করলেও দুই একটি কারখানায় নামমাত্র জরিমানা করা ছাড়া কার্যকরী তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কারখানা মালিকদের এই দৌরাত্ম্যকে অনেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করছেন। তেঁতুলিয়া চা চাষি ইউসুফ আলী বলেন, আমরা কষ্ট করে চা আবাদ করি আর কারখানা মালিকরা বিনাশ্রমে অর্ধেক চা নিয়ে নেয়। তারা আমাদের মানুষ মনে করে না। বর্তমানে চা পাতা বিক্রি করে যে টাকা পাচ্ছি তা দিয়ে কামলা খরচ আর পথ খরচই উঠে না। এদিকে ঋণের কিস্তির জন্য এনজিও লোক বাড়িতে বসে থাকে। কিস্তির টাকা দিতে পারিনা। সার কীটনাশকের দোকানে বাকি সেই টাকাও পরিশোধ করতে পারছি না। তাই বাগানই কেটে ফেলেছি।
চা চাষি কাজী মোকছেদ বলেন, বাজারে তৈরি চায়ের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। অথচ কাঁচা চায়ের দাম প্রতিনিয়ত কমছে। মূলত সমতলের চা শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য কারখানা মালিকরা এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। প্রশাসনের ভূমিকাও রহস্যজনক। তারা ব্যবস্থা নিতে নিতে দেখা যাবে মৌসুম শেষ হয়ে গেছে। কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও চা চাষি আব্দুল লতিফ তারিন বলেন, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ চা চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটে পড়ে লোকসান হওয়ায় তারা বাগান ভেঙে ফেলছেন। কারখানা মালিকরা দাম কমার পেছনে বড় পাতাকে দায়ী কারছেন। কিন্তু তারা কম দাম ও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ওজন থেকে বাদ দিয়ে ঠিকই বড় পাতা নিয়েই চা বানাচ্ছেন। এছাড়া তারা ভালো মানের চা কাস্টমসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিদিন কালোবাজারে বিক্রি করছেন। আর নিন্মমানের চা নিলাম বাজারে সরবরাহ করে কম দাম পাওয়ার অভিযোগ তুলছেন। পঞ্চগড়ের চা শিল্প বাঁচাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খরার কারণে চা মৌসুমের শুরুতে তেমন পাতা পাওয়া যায়নি। এখন সব চাষির পাতা একসঙ্গে উঠছে। ধারণ ক্ষমতা না থাকলেও মানুষের আকুতি মিনতিতে আমাদের ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুন চা বর্তমানে কিনতে হচ্ছে। ছোট পাতা সরবরাহ করলে ১৮ টাকা দরেই কেনা হচ্ছে। তবে বর্তমানে চা চাষি ও কারখানা মালিকদের মাঝে একটি দালালচক্র ঢুকেছে। কারখানাগুলো ১০ শতাংশ কর্তন করলে তারা ২০% কর্তন করে। তবে বাগান মালিকদের মধ্যে যেমন কিছু অসাধু মানুষ রয়েছেন তেমনি কিছু অসাধু কারখানা মালিকও রয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। এছাড়া সমসাময়িক নানা কারণে পঞ্চগড়ের কারখানা মালিকদের সংগঠনের সভাপতির পদ থেকেও অব্যাহতির জন্য আবেদন জানিয়েছেন বলে জানান তিনি।