ব্রিটিশ শাসন
প্রশ্ন : সাহিত্যিকরা রাজনৈতিক আন্দোলনে কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারেন?
উক্তর : সাহিত্যিকরা রাজনৈতিক আন্দোলনকে, নিজের স্বাধিকার আন্দোলন আদায়ের জন্য রাজপথে নেমে মিছিল করে না। তারা নিজেদের সৃজন মেধা দিয়ে, নিজের ক্ষুরধার সম্পন্ন লেখনী দ্বারা পিছিয়ে পড়া ঘুমন্ত জাতিকে তাদের চেতনা ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করেন। তারা তাদের গান, কবিতা ও লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে চাঙা করে রাজনৈতিক চেতনা বোধের জন্ম দেন। ফলে এগিয়ে চলে রাজনৈতিক আন্দোলন। যুগে যুগে বহু সাহিত্যিক তাদের শক্তিশালী লিখনীর মাধ্যমে সমাজ ও জাতির পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম নবজাগরণ ঘটিয়েছেন। বেগম রোকেয়া তার নারীবাদী লেখনীর মাধ্যমে সমাজে অবদান রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথ-নজরুলসহ নানা সাহিত্যিকের তীব্র, জ্বালাময়ী লেখনীর কারণে ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে। ১৯৫২, ১৯৭১ সালের নানা রাজনৈতিক কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে সাহিত্যিকদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শিল্প-সাহিত্যিকদের নাটক, ক্রোড়পত্র মুক্তিযোদ্ধা রক্তে এনেছিল বাঁধভাঙা জোয়ার আর উদ্যম।
এভাবে সারা বিশ্বে যুগে যুগে রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরোটাজুড়েই থাকেন সাহিত্যিকরা। তারা লেখনীর মাধ্যমে রাজনীতিকদের উদ্দীপনা জোগান। ফলে রাজনৈতিক আন্দোলন হয় আরও বেগবান ও সাফল্যমণ্ডিত।
প্রশ্ন : পলাশীর যুদ্ধ কেন হয়েছিল? এ যুদ্ধের ফলাফল কী ছিল?
উত্তর : পলাশীর যুদ্ধ : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার পলাশীর আম্রকাননে বাংলার নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের যে প্রহসনমূলক যুদ্ধ হয় তা-ই ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত।
কারণ : সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তিনি ছিলেন বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁর দৌহিত্র। নানার মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার মাত্র এক বছর পরে পলাশীর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এ যুদ্ধের কারণগুলো নিচে দেওয়া হলো-
* সিংহাসনে আরোহণ করেই তরুণ নবাবকে নানা ষড়যন্ত্র ও বিরোধী শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। * তার সামনে একদিকে ছিল ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান শক্তি আর অন্যদিকে বড় খালা ঘসেটি বেগম, সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের মতো ঘনিষ্ঠজনদের ষড়যন্ত্র। * এ ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় রায় দুর্লভ এবং জগৎ শেঠের মতো শক্তিশালী বণিক গোষ্ঠী। * এ সময় বাংলায় ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্য সংস্থার নাম ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নানা কারণে নবাবের সঙ্গে ইংরেজ বণিকদের বিরোধ দেখা দেয়। * ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের বিরোধী দেশীয় শক্তিগুলো একযোগ হয়ে যোগ দেয় ষড়যন্ত্রে। এরা সবাই নবাবকে উৎখাতের চেষ্টা করে। এসবের জের ধরেই পলাশীর আম্রকাননে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের প্রহসনমূলক পলাশীর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়।
ফলাফল : * পলাশীর যুদ্ধে নবাবের সেনাপতি বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের পক্ষ নেয়। ফলে পলাশীর যুদ্ধে নবাব পরাজিত হয় ও পরে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। * এ যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলায় ইংরেজ শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। * এ যুদ্ধের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
প্রশ্ন : বাংলার শিক্ষা ও অর্থনীতিতে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব কী ছিল?
উত্তর : ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়। বাংলার শিক্ষা ও অর্থনীতিতে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ছিল নিুরূপ-
শিক্ষা : * ইংরেজদের মাধ্যমে এ দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়। * শিক্ষা বিস্তারে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
* ছাপাখানার বিকাশে জ্ঞান বিস্তারের সুযোগ বাড়ে। * আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষার ফলে এ দেশে ক্রমে একটা ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে ওঠে। এদের একাংশের মধ্যে নতুন চেতনার বিকাশ ঘটতে থাকে। * এরা নিজেদের সমাজে বহুকাল ধরে প্রচলিত নানা কুসংস্কার, কুপ্রথা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। এদের হাত ধরেই উনিশ শতকে বাংলায় নবজাগরণ ঘটে। যার ফলে সামাজিক সংস্কারসহ শিক্ষা, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। নবজাগরণের কয়েকজন প্রধান ব্যক্তি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ। * মুসলমানদের সামাজিক সংস্কার ও আধুনিক শিক্ষার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আবদুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলী।
অর্থনীতি : এ দেশ ইংরেজ শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শোষণ ও নিজেদের লাভ। প্রায় ২০০ বছরের এ শাসনকালে প্রচুর অর্থ ও সম্পদ এ দেশ থেকে পাচার হয়ে যায়। বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি ও এককালের তাঁতশিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলার শিল্প, বাণিজ্যও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অসংখ্য কারিগর বেকার হয়ে যায়। কোম্পানির শাসনের সময় ১৭৭০ (বাংলা ১১৭৬) সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, যা ইতিহাসে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত।
সুতরাং বাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব অনেকটা ইতিবাচক হলেও বাংলার অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল অত্যন্ত নাজুক ও হতাশাজনক।