পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে
গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে যে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে
অন্তত দুটি প্রদেশে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছে। পাঞ্জাব এবং খাইবার
পাখতুনখোয়া প্রদেশে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনা নামানো হচ্ছে।
সর্বশেষ দফা বিক্ষোভের সময় বিক্ষোভকারীরা লাহোরে এক সেনা অধিনায়কের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে রাওয়ালপিন্ডিতে বিক্ষোভকারীরা সেনা সদর দপ্তরের প্রবেশ মুখ অবরোধ করেছে।
মঙ্গলবার রাত হতেই পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের খন্ড লড়াই চলছে।
বুধবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ইসলামাবাদের পুলিশ সদর দপ্তরের ভেতর এক বিশেষ আদালতে হাজির করা হয় এক দুর্নীতির মামলায়। স্থানীয় গণমাধ্যমকে উদ্ধৃত করে এএফপি জানাচ্ছে, সরকারি কৌসুলিরা খানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজতে রাখার আবেদন জানিয়েছেন।
জিও টিভি জানায় , আদালতে শুনানি চলার সময় খানকে তার কৌঁসুলিদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়। তবে রুদ্ধদ্বার আদালত কক্ষে অনুষ্ঠিত এই শুনানির বিস্তারিত এখনো জানা যায়নি।
কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, পাঞ্জাব প্রাদেশিক সরকার এবং সামরিক কর্তৃপক্ষ আলোচনা করে ঠিক করবে কত সেনা সেখানে মোতায়েন করা হবে।
এর আগে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েনের অনুরোধ জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি পাঠায়। এতে লাহোর, মুলতান, রাওয়ালপিন্ডি, ফয়সলাবাদ এবং অন্যান্য জেলা শহরে সেনা মোতায়েনের কথা বলা হয়।
খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশেও সেনা ডাকা হয়েছে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ জানান, পেশাওয়ারের বিভিন্ন জায়গায় সহিংস বিক্ষোভ চলার সময় অন্তত ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, তারা সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দাঙ্গাকারীদের ধরার চেষ্টা করছে। পুলিশ আরও জানিয়েছে, এ পর্যন্ত দেশজুড়ে এক হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পাকিস্তানে গত কয়েক মাস ধরে একটানা রাজনৈতিক সংকট এবং চরম উত্তেজনার মধ্যে গতকাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সাবেক এই ক্রিকেটার অভিযোগ করেছিলেন যে একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। পাকিস্তানের খুবই ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী অবশ্য পাল্টা জবাবে এর কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ
ইমরান খানের দল অভিযোগ করছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য খানকে মিথ্যে মামলায় গ্রেপ্তার করেছে সরকার। পাকিস্তানের সরকার অবশ্য ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পেছনে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’র কথা অস্বীকার করেছে।
সরকারের আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইমরান খানের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছে পাকিস্তানের ‘ন্যাশনাল একাউন্টেবিলিটি ব্যুরো, যা পাকিস্তানের দুর্নীতি বিরোধী সর্বোচ্চ সংস্থা। আদালতে বার বার তলব করার পরও খান হাজির হতে অস্বীকার করেছেন।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যখনই তাকে আদালতে ডাকা হয়েছে, তিনি তার সময়মতো সেখানে গেছেন, তাও আবার চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি পাওয়ার পর।’
পাকিস্তানে সাবেক সরকার প্রধান বা রাজনীতিকদের গ্রেপ্তার করা কোনো নতুন ঘটনা নয়। তবে সেখানে সেনাবাহিনীকে এভাবে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার ঘটনা খুবই বিরল। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত অনেক সেনা অভ্যুত্থান করেছে এবং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তারাই দেশটি শাসন করেছে।
ইমরান খানকে গত বছরের এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়। তিনি চার বছরেরও কম সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
গত বছরের নভেম্বরে যখন তিনি পাকিস্তানের ওয়াজিরাবাদ শহরে প্রচারণা করছিলেন, তখন তার পায়ে গুলি করা হয়। তিনি এই ঘটনার জন্য একজন ঊর্ধ্বতন সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে দায়ী করেছিলেন।
ইমরান খানের দল পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির একজন সিনিয়র নেতা ফাওয়াদ চৌধুরি বলেছেন, সরকার ষড়যন্ত্র করে পাঞ্জাবে জনগণ এবং সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেন, রাজনৈতিক লড়াইটা চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, কিন্তু পিডিএম সরকার জনগণ এবং সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি করে দিয়েছে। তার মতে, তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি হচ্ছে পাকিস্তানের মধ্যবিত্তদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, অন্যদিকে সেনাবাহিনী হচ্ছে পাকিস্তানে মধ্যবিত্তের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান।
তিনি পাকিস্তানের সেনা প্রধান এবং সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’ এর প্রধানের প্রতি আহ্বান জানান এই ষড়যন্ত্রে সামিল না হওয়ার জন্য। তিনি তার দলের কর্মীদের প্রতি শান্ত থাকারও আহ্বান জানান।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি
ইমরান খান যখন ২০১৮ সালে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসেন তখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার মধুর সম্পর্ক ছিল। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, সেনাবাহিনী সাহায্য নিয়েই তিনি সেবার বিজয়ী হন। কিন্তু চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে একটা পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়।
গত কয়েক মাসের ঘটনায় বোঝা যায়, তাদের সম্পর্ক এখন কতটা বৈরি হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর ইমরান খান হয়ে ওঠেন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে কঠোর সমালোচক।
এদিকে পাকিস্তানের অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা সংযম প্রদর্শন এবং আইনের শাসন বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এরকম পরিস্থিতিতে সংযম প্রদর্শন এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার। পাকিস্তানের যেসব চ্যালেঞ্জ তা মোকাবেলা এবং দেশটি কোন পথে যাবে তা একমাত্র পাকিস্তানের জনগণই নির্ধারণ করতে পারে। সেটা করতে হবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এবং আইনের শাসন বজায় রেখে।’