শিশুকে অপহরণের পর পরিবারের কাছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করত চক্রটি। গত ছয় থেকে সাত বছরে রাজধানীর উত্তরা ও আশপাশের এলাকা থেকে ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সি ৫ শতাধিক শিশুকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০০ টাকাও নিয়েছে। আর মুক্তিপণের টাকায় মাদক সেবন করত চক্রটি, চলত ফুর্তি।
দুই জন ছাত্রকে অপহরণের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) উত্তরা বিভাগ। পুলিশ বলছে, গরিব কিংবা ধনী যে পরিবারেরই সন্তান হোক না কেন, তাদের কাজ হলো অপহরণ করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা। উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুর কেন্দ্রিক চক্রটি শিশুদের ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর পরিবারকে ফোন করে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করত। টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দিত। চক্রটি ভুক্তভোগীদের কাছে ‘মানবিক অপহরণকারী’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কারণ কখনো কখনো মুক্তিপণ না পেলেও অপহৃত শিশুর কোনো ক্ষতি করেনি।
গত শুক্রবার ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোর্শেদ আলমের তত্ত্বাবধানে অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে চক্রের মূল হোতা মিল্টন মাসুদকে গ্রেফতার করে। এ সময় মিল্টনের দুই সহযোগী শাহীনুর রহমান ও সুফিয়া বেগম নামে আরেক নারীকেও গ্রেফতার করা হয়। গতকাল ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে চক্রের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন ডিসি মোর্শেদ আলম।
ডিসি মোর্শেদ আলম জানান, সম্প্রতি উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টর থেকে শাহিন নামে এক শিশু নিখোঁজ হলে থানায় জিডি করা হয়। সেই জিডির সূত্র ধরে পুলিশ তদন্তে নেমে এ চক্রের সন্ধান পায়। চক্রের মূল হোতা মিল্টন মাসুদের নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা শিশু শাহিনকে অপহরণ করার কথা পাওয়ার পর গাজীপুরের সালনা এলাকা থেকে মিল্টন মাসুদকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যে শিশু শাহিনকে উদ্ধারের পাশাপাশি শিশু অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়ে বেশ চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে।
পুলিশ জানিয়েছে, অপহরণকারী চক্রের মূল হোতা মিল্টন মাসুদ আগে থেকেই মাদকে আসক্ত। এ কারণে সে শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ে জড়িয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা ও তিনটি শিশু অপহরণ মামলা রয়েছে। এসব মামলায় সে একাধিকবার জেলেও ছিল। অপহরণ করে যে টাকা পেত সেই টাকা সহযোগী মো. শাহীনুরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিত। শাহিনুর মাতৃভান্ডার নামে একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক বলে নিজেকে পরিচয় দিত। পাঁচ বছর পূর্বে শাহীনুরের সঙ্গে মিল্টনের সখ্যতা গড়ে উঠে। মূলত মিল্টন মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার পর সেগুলো দিয়ে ইয়াবা সেবন ও মদ পান করত। মাদকের পিছনেই সে সব টাকা খরচ করত। অন্যদিকে শাহীনুরও মুক্তিপণের টাকা নিয়ে মাদক সেবনসহ নানা ধরনের আনন্দ-বিনোদনের পিছনে ব্যয় করত। বিভিন্ন সময়ে কোনো ঝামেলা হলে তা মোকাবিলায় শাহীন মাসুদকে সহযোগিতাও করত।
পুলিশ বলছে, এই অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে ঘোরাফেরা করে। তাদের টার্গেট ছয় থেকে ১৪ বছরের শিশু। যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। তবে বাবা কিংবা মায়ের মোবাইল ফোন নাম্বার মুখস্থ। কিছু সময় শিশুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ঐ শিশুর পরিবারের কাছে টাকা দাবি করা হয়। ৫০০ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়। এ চক্রের অপহরণের শিকার হয়েছে রাজউক মডেল স্কুলের ৮ম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী মাহির আশরাফ ও মাদ্রাসা ছাত্র মুত্তাকিনসহ ৫ শতাধিক শিশু।
মাহির আশরাফের বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত। ঐ শিশু জানায়, গত ৩ মে স্কুল থেকে ফেরার সময় মিল্টন নামক ঐ আঙ্কেলটা বলে তোমার নাম কী, বাবার নাম কী, মা কেমন আছে? নানা সাধারণ কথা বলে। এরপর বাবার নাম্বার নিয়ে আমাকে ধরিয়ে দেয়। আমাকে বলে, বলো কবির আঙ্কেল কথা বলবে। এরপর ফোনটা কেটে দেয়। এরপর আমি স্কুল থেকে কোচিং-এ চলে যাই। বাসায় ফিরে শুনি আমাকে নাকি অপহরণ করা হয়েছিল। বাবা ভয় পেয়ে তাকে ২৫ হাজার টাকা বিকাশ করে দিয়েছে।
অপহরণকারী চক্রের কৌশল সম্পর্কে আরেক শিশু মুত্তাকীর বাবা বাহার উদ্দিন বলেন, গত ২৪ রমজান আমি ইতিকাফে বসা ছিলাম। মাদ্রাসা থেকে ফোন আসে, ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে বাচ্চাকে কি বাসায় পাঠায় দেবো? আমি পাঠাতে বলি। কিন্তু আধা ঘণ্টা পার হলেও মুত্তাকী বাসায় পৌঁছেনি। বাসার দারোয়ান ফোন করে জানায় মুত্তাকী এখনো আসেনি। এর কিছুক্ষণ পরই ফোন করে মুত্তাকীকে অপহরণের কথা জানায়। আর টাকা পাঠাতে বলে। এরপর দিশেহারা হয়ে যায় মুত্তাকীর মা। টাকা পাওয়ার পর টঙ্গী বাজারে একটি হোটেলের ঠিকানা দিয়ে অপহরণকারী বলে, সেখানে আছে মুত্তাকী। বাহার বলেন, দুই দফায় ১০ হাজার টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে। খবর পেয়ে আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে থানায় অভিযোগ করি