চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাউন্সিলর হয়েও একাধিকবার পাহাড় কাটার মামলার আসামি হয়েছেন জহুরুল আলম জসিম। একই মামলার আসামি তার স্ত্রীও। পাহাড় কেটে প্লট করে বিক্রির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েকশ কোটি টাকা। পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট হলেও তিনি গ্রেফতার হননি। বরং চট্টগ্রামে ‘পাহাড়খেকো’ হিসাবে পরিচিত কাউন্সিলর জসিম চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্ট্যাডিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
সর্বশেষ গত শুক্রবার নগরীর আকবরশাহ থানাধীন বেলতলী ঘোনা এলাকায় পাহাড় কাটার সময় মাটি চাপা পড়ে একজন নিহত হওয়ার ঘটনায় আবারও সামনে আসে এই জসিমের নাম। এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হয়েছে।
এদিকে রোববার সকালে পরিবেশ ভবনের সামনে ‘মাদক সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন’ ব্যানারে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয়রা। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও যোগ দেন। পরে কাউন্সিলর জসিম ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে সংগঠনের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
জানা গেছে, চসিকের ২০১৫ সালের নির্বাচনে কাউন্সিলর হিসাবে জয়লাভ করেন জহুরুল আলম জসিম। পাহাড়ে জনবসতি নিরুৎসাহিত করতে অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বারবার তাগিদ দিচ্ছে জেলা প্রশাসন গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। তা না করে উলটো অবৈধ বসবাসকারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় কাজ করে যাচ্ছেন জহুরুল আলম। পাহাড়ি এলাকায় প্লট বিক্রি করতে পাকা সড়ক নির্মাণ দিয়েছেন তিনি। পাহাড় কাটার মামলা এবং নানা বিতর্কের কারণে ২০২১ সালের নির্বাচনে তাকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তবে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। জহুরুল আলম বর্তমানে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক।
সরেজমিন আকবরশাহ থানার বেলতলী ঘোনা এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেলতলী ঘোনায় প্রায় দেড় হাজার পরিবারের বসবাস। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির মতে, এর মধ্যে ৩০০ পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। এসব বাসিন্দাদের অধিকাংশই হাত বদলের মাধ্যমে স্থানীয় কাউন্সিলর জসিমের মাধ্যমে জমি কিনে সেখানে বসবাস করছেন। তার নিয়ন্ত্রণেই আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় কাটা চলে। এজন্য এলাকাভিত্তিক নিজের একটি বাহিনীও রয়েছে কাউন্সিলর জসিমের। তারা মূলত জসিমের প্রভাব খাটিয়ে সরকারি খাস ও রেলওয়ে পাহাড় দখল করে বিক্রি করে থাকেন। বেলতলী ঘোনা এলাকায় স্থানীয় ইসমাইল, ফারুক, ইদ্রিস, সেলিম, বছির ও তোয়ান ওরফে সুমন কাউন্সিলর জসিমের অনুসারী হিসাবে পরিচিত। এদের মধ্যে ইসমাইল এসব কিছুর তদারক করে থাকেন। অন্যরা পাহাড় কেটে জমি বিক্রি ছাড়াও বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের ব্যবসা করে থাকেন। তাদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় কাউন্সিলর জসিম। পাহাড়ে জায়গা দখল নিয়ে হতাহতের ঘটনায় মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। তবে জসিমের ইশারায় ভুক্তভোগীরাই উলটো মামলার আসামি হয়েছেন হয়েছেন। পরিবেশ অধিদফতর সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ২৮ মে পাহাড় কাটার অভিযোগে কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ ছাড়া পাহাড় কাটার দায়ে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলর জসিমের স্ত্রী তাছলিমা বেগমকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে অধিদপ্তর। এরপর গত বছরের ১০ আগস্ট আকবরশাহ থানার লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগে কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের শুনানিতে জসিমের কেয়ারটেকারের স্বীকারোক্তি এবং তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দায়ের করা মামলায় কাউন্সিলরের স্ত্রীসহ মোট তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন কাউন্সিলর জসিম, তার স্ত্রী তাছলিমা বেগম ও কেয়ারটেকার মোহাম্মদ হৃদয়।
কোনো মামলায় গ্রেফতার হননি কাউন্সিলর জসিম : পাহাড় কাটার অভিযোগে কাউন্সিলর জসিম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় তিনটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এছাড়া পাহাড় কাটা পরিদর্শনে গিয়ে হামলার শিকার হওয়ার ঘটনায়ও তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলায় কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। তবে কোনো মামলায় এখন পর্যন্ত তিনি গ্রেফতার হননি। বরং অদৃশ্য শক্তি কাজে লাগিয়ে তিনি চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতির পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। গত ২৬ জানুয়ারি পাহাড় কেটে খাল ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণের স্থান পরিদর্শন গিয়ে হামলা ও বাধা দেওয়ার ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। মামলায় কাউন্সিল জসিমকে প্রধান আসামি করা হয়।
কাউন্সিলর জসিমের স্বেচ্ছাচারিতায় নিজ দলের নেতাকর্মীরাও অতিষ্ঠ। জসিমের বিরুদ্ধে রোববার মাদকসন্ত্রাস প্রতিরোধ ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন ব্যানারে মানববন্ধনে যোগ দেন আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাব হোসেনসহ অধিকাংশ নেতা। সরকারের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে কাউন্সিলর জসিমকে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জহিরুল আলম জসিম বলেন, একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসাবে আমাকে হেয় করতে এসব অভিযোগ করছে। আমি গত ২৫ বছর ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য করছি। এ বছর ১৪ লাখ টাকা ইনকাম ট্যাক্স দিয়েছি। এছাড়া বেলতলী ঘোনার বিষয়ে যেখানে মেয়র সাহেব বলেছেন, প্রকল্পটি এডিবির অর্থায়নে চসিক ব্যবস্থাপনায় হচ্ছে সেখানে আমাকে উলটোভাবে জড়ানো হচ্ছে।’