গত বছর বালুচরে কুমড়া চাষ করে আশানুরূপ লাভবান হওয়ায় এ বছর রংপুর কৃষি
অঞ্চলের ৫ জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুরও গাইবান্ধায়
বেড়েছে মিস্টি কুমড়ার চাষ। পাশাপাশি এ বছর কুমড়ার বা¤পার ফলন ও আশানুরূপ
দাম পাওয়ার আশা করছেন চাষিরা। কারণ মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুরে রপ্তানি হচ্ছে
মিষ্টিকুমড়া। রপ্তানিকারক দুটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ২০ কোটি টাকার
মিষ্টিকুমড়ার অর্ডার পেয়েছে। সেজন্য তারা সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে কুমড়া
কিনে প্যাকেটজাত করে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে চরাঞ্চলে বসবাসকারী মিষ্টিকুমড়া
চাষিরা ভীষণ খুশি। কারণ উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে তাদের আগের মতো
ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে না। দামও ভালো পাচ্ছেন।
শনিবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে জানা যায়, চলতি বছর এই ৫ জেলায় কুমড়া চাষ হয়েছে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ লাখ ১৫ হাজার টন। যা এ অঞ্চলের বিগত সময়ের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এর আগে ২০২২ সালে কুমড়া চাষ হয়েছিল ১২ হাজার হেক্টর ও ২০২১ সালে কুমড়া চাষ হয় মাত্র ১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। সুত্র বলছে চর এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার কৃষক কুমড়া চাষের সঙ্গে জড়িত।
শুষ্ক মৌসুমে নদ নদীর পানি শুকিয়ে যায়। ফলে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তানদ-নদীর
বুকে এখন বিস্তীর্ণ বালু চর। চরের কৃষকরা চরে উপযোগী ফসল ফলাচ্ছেন। কয়েক
বছর ধরে বালু মাটিতে কুমড়া, গম ভুট্টা, ধান, আলুসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করে
লাভবান হচ্ছেন তারা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে কৃষকদের কারিগরি ও বীজ দিয়ে
সহায়তা দিচ্ছে কৃষি বিভাগ ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। তবে অধিকাংশ কৃষকই
নিজ উদ্যোগে বালু মাটিতে কুমড়া চাষ করছেন। কৃষকরা জানায় প্রতি বিঘা জমিতে
৮০০ থেকে ১ হাজারটি কুমড়া হয়। প্রতিটি কুমড়ার ওজন ৫-১০ কেজি হয়ে থাকে। গত
বছর তারা খেত থেকেই প্রতি কেজি কুমড়া ১০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। এবার
দাম আর বেশি। বিদেশে কুমড়া যাচ্ছে বলে এবার ১৯ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চরাঞ্চলে আবাদ করা মিষ্টিকুমড়ার চাহিদা এখন ব্যাপক। অনেক জেলায় পাইকাররা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আর এবার দামও ভালো পাচ্ছেন চাষিরা। দুই দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশও মিষ্টিকুমড়া কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মিষ্টিকুমড়াও দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারবে।
গঙ্গাচড়া উপজেলার ৯০ ভাগ এলাকাই তিস্তা নদীবেষ্টিত। এখানে দেড় শতাধিক
ছোট-বড় চর রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি চরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মিষ্টিকুমড়ার চাষ
হচ্ছে। মূলত শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টিকুমড়া চাষ করা হয়। মিষ্টিকুমড়া চাষি আফজাল
হোসেন জানালেন, তিনি ২০ বিঘা জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত ১০
লাখ ৪০ হাজার টাকার মিষ্টিকুমড়া বিক্রি করেছেন। এখনো জমিতে অনেক কুমড়া
আছে।
আশা করছেন, আরও ৫ লাখ টাকার মিষ্টিকুমড়া বিক্রি করতে পারবেন। তিনি জানান, উন্নত জাতের মিষ্টিকুমড়া আগের মতো ৮ থেকে ১০ কেজির হয় না। এটি সর্বোচ্চ ৪-৫ কেজি ওজনের হয়। তবে চাহিদা বেশি ২-৩ কেজি ওজনের মিষ্টিকুমড়া। প্রথম দিকে ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। এখন ১৮-১৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। মিষ্টিকুমড়ার চাষি সাদেক আলী জানালেন, তিস্তা নদী এলাকার চরে এমফরসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সহায়তায় তাদের মিষ্টিকুমড়া চাষে সহায়তা করছে।
ছালাপাক চরের মিষ্টিকুমড়া চাষি আহমেদ আলী, সোলায়মান আলী, সাহেব মিয়া,
জিন্নাতুন নেছাসহ কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার গত দুবছরের
চেয়ে দাম ভালো পাচ্ছেন তারা। প্রতি কেজি ১৯ টাকা দরে মিষ্টিকুমড়া তাদের কাছ
থেকে ঢাকা ও রংপুরের তিন রপ্তানিকারক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে একদিকে তাদের
সচ্ছলতা ফিরে আসছে, অন্যদিকে শত শত ভূমিহীন শ্রমিকও কাজ পাচ্ছেন। তাদেরও
আয় হচ্ছে ভালো।
নীলফামারীর টেপাখড়িবাড়ি এলাকার জেসমিন আক্তার (৩২) ও তার স্বামী
মোস্তাফিজার রহমান বলেন, গত বছর ২০ শতাংশ জমি থেকে ৪ হাজার ৩০০ কেজি কুমড়া
পেয়েছিলাম। সেগুলো ৪৩ হাজার টাকায় বিক্রি করি। খরচ হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। এ
বছর ২০ শতাংশ জমিতে কুমড়া চাষ করেছি উল্লেখকরে বলেন, একটি বেসরকারি সংস্থা
বীজ, সার ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।
আশা করছি গত বছরের তুলনায় এ বছর ভালো ফলন ও দাম পাবো। কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র পাড়ের স্বল্প আয়ের পরিবারের লোকজনকে কর্মমুখী রাখতে সহযোগিতা করছে সাসটেইনড অপরচুনিটিজ ফর নিউট্রিশন গভর্নেন্স (সঙ্গো) প্রকল্প। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশ ও কর্ডএইড। ব্রহ্মপুত্রের চর জোরগাছ এলাকার সালেহা বেগম (৫০) বলেন, ৫ জন মিলে চরে এক একর জমিতে কুমড়া চাষ করেছি।
গত বছর এই জমিতে কুমড়া চাষ করে প্রত্যেকে ৪০ হাজার টাকা করে ভাগ পেয়েছি।
আশা করছি, এ বছর আয় আরও বাড়বে। প্রকল্পটির চিলমারী উপজেলা ব্যবস্থাপক
আহসানুল কবির বুলু বলেন, পরিবারে পুষ্টি-চাহিদা মেটাতে চরের স্বল্প আয়ের
মানুষকে কুমড়াসহ বেশকিছু সবজি উৎপাদনে সহযোগিতা করা হচ্ছে। তারা কুমড়া
উৎপাদন করে নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও তা বিক্রি করে আশানুরূপ আয় করছেন। তাদের
বীজ-সার ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি।
ব্রহ্মপুত্রের চর পার্বতীর মিজানুর রহমান (৫৬) বলেন, এ বছর চরে ৫৫০টি কুমড়া
চারা লাগিয়েছি। খরচ হয়েছে ৯ হাজার টাকা। আশা করছি ৫০-৫৫ হাজার টাকার কুমড়া
বিক্রি করতে পারব। গত বছর ৫ হাজার টাকা খরচ করে ২০০টি চারা লাগিয়ে কুমড়া
বিক্রি করেছি ৩২ হাজার টাকা। জৈব সার ব্যবহার করে চরে কুমড়া চাষ করছি।
সেচের পানি পেতে বেগ পেতে হয়, যোগ করেন তিনি।
লালমনিরহাটের চর গোকুন্ডা এলাকার আহাদুল ইসলাম (৬০) বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে নিজ উদ্যোগে চরে কুমড়া চাষ করে আসছি। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতি বছর কুমড়া বিক্রি করে ৬০-৭০ হাজার টাকা আয় করি। সঠিকভাবে যতœ নিলে বালু মাটিতে কুমড়ার ফলন খুবই ভালো হয়। এ বছর তিনি প্রায় ২ বিঘা জমিতে কুমড়া চাষ করেছেন বলেও জানান। কুমড়াচাষি শাহজাহান আলী, মমতাজ উদ্দিনসহ অনেকেই জানালেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ফরিদপুরসহ কমপক্ষে ২০টি জেলায় মিষ্টিকুমড়া যাচ্ছে। এছাড়া সেনাবাহিনী, বিডিআরসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের তরকারি হিসেবে মিষ্টিকুমড়ার চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়াও বড় বড় হোটেলে মাংসসহ বিভিন্ন তরকারিতে মিষ্টিকুমড়ার ব্যাপক ব্যবহার হয়।
এদিকে ছালাপাক তিস্তার চরের বাজারে, বিদেশে রপ্তানির জন্য মিষ্টিকুমড়া কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে সেলাই করা হচ্ছে। মালয়েশিয়ায় রপ্তানির অর্ডার পাওয়া রংপুর অ্যাগ্রোর কর্মকর্তা রতন জানালেন, তারা চাষিদের কাছ থেকে ১৯ টাকা কেজি দরে মিষ্টিকুমড়া কিনছেন। এরপর প্যাকেটজাত করে ট্রাকে করে চট্টগ্রাম নিয়ে যাচ্ছেন। আরেক রপ্তানি কারক চান্দ মিয়াও জানালেন একই কথা। সেইসঙ্গে বললেন, দুই দেশে ২০ কোটি টাকার মিষ্টিকুমড়ার অর্ডার পেয়েছেন তারা।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপরিচালক কৃষিবিদ ওবায়দুর রহমান জানালেন, ‘চরের বালু মাটিতে বেশির ভাগ কুমড়া হচ্ছে।
গত বছর কুমড়া চাষে চরের কৃষকরা লাভবান হওয়ায় এ বছর কুমড়া চাষ বেড়েছে।’তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক বছর আগে উৎপাদিত কুমড়া বিক্রি নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তা করতেন। এখন কুমড়ার ব্যাপক চাহিদা থাকায় তাদের দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না। আপাতত মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুর এই দুই দেশে মিষ্টিকুমড়া রপ্তানি হলেও চরাঞ্চলের উৎপাদিত মিষ্টিকুমড়ার চাহিদা দেশেও রয়েছে। এতে চাষিরাও লাভবান হচ্ছেন। তবে সেইদিন বেশি দূরে নয়, যখন মিষ্টিকুমড়া বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।