গত তিন দশকে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে এই সংক্রান্ত কার্যক্রম। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বাড়লেও এখনো শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশের সুযোগ থেকে পিছিয়ে আছে প্রতিবন্ধী শিশুরা। সংবিধান, প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন-২০০১ এবং সংশ্লিষ্ট নীতিতে এসব শিশুর শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার বলা হয়েছে। তারপরও অভিভাবকরা মনে করেন, দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার প্রকৃত সুযোগ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এখনো আশানুরূপ নয়। এমন প্রেক্ষাপটে আজ রবিবার বাংলাদেশে উদযাপিত হবে ১৬তম ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারসংক্রান্ত জাতিসংঘের সনদ অনুসমর্থন ও অনুস্বাক্ষরকারী দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। এই সনদের দায়দায়িত্বের অংশ হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নানা কর্মসূচির মাধ্যমে রবিবার দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘রূপান্তরের অভিযাত্রায় সবার জন্য নিউরোবান্ধব অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্ব গঠন।’
অভিভাবকরা বলছেন, দেশের মূল শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রবেশাধিকার তেমন নেই, আলাদা ধারায় গড়ে ওঠা বিশেষ শিক্ষা ও সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থায় অংশ নিচ্ছে এসব শিশুদের বড় অংশ। আর সে ক্ষেত্রেও এ ধরনের শিক্ষা উদ্যোক্তা এবং শিক্ষকরাও কাক্সিক্ষত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে দাবি আদায়ে রাজপথে নামতে হচ্ছে তাদের।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে মাত্র ৬৫ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাত্র ৩৫ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে পারছে। এখনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকছে ৬০ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু। আর যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রবেশ করছে তারাও বয়স অনুপাতে গড়ে দুই বছর পিছিয়ে থাকছে। ইউনিসেফের সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ (এনএসপিডি) ২০২১’ নামের ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১.৭ শতাংশ শিশু ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’-এ সংজ্ঞায়িত ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার অন্তত একটি প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বেঁচে আছে। অন্যদিকে ৩.৬ শতাংশ শিশুর অন্তত এক ধরনের ‘ফাংশনাল ডিফিকাল্টি’ রয়েছে। ফাংশনাল ডিফিকাল্টির বিভিন্ন ধরনের মধ্যে রয়েছে দেখা, শোনা, হাঁটা, আঙুল ব্যবহার করে সূক্ষ্ম কাজ করা, যোগাযোগ, শেখা, খেলা বা আচরণ নিয়ন্ত্রণ।
জানা গেছে, প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সারা দেশে সরকারি স্কুল আছে ৫৫টি। আসন সীমিত হওয়ায় অনেক প্রতিবন্ধী শিশু এগুলোতে ভর্তির সুযোগই পায় না। ফলে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন অভিভাবকরা।
রাজধানীর রামপুরার একজন অভিভাবকের দুই সন্তানের একজন বাক ও আরেকজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। চিকিৎসকের পরামর্শে বাকপ্রতিবন্ধী ছেলেকে সাধারণ স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু কোথাও সুযোগ পাননি। পরে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) সহায়তায় পরিচালিত একটি বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। রাজধানীর রমনা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সুলতানা খানম বলেন, সরকারিভাবে অটিজম শিশুদের কথা শোনা যায়, কিন্তু আমাদের সন্তানের জন্য তো কোনো সহযোগিতা পাই না।
মূলধারার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকার অ্যাডভোকেট অহিদুল ইসলাম। কিন্তু সেখানে শিশুটির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। আমাদের সময়কে অহিদুল জানান কিছু শিক্ষকও তার সন্তানকে নিরুৎসাহিত করেন।
২০০৯ সালে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে পুরনো অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকার কথা স্বীকার করেছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ। তারা জানান, নতুন ভবন নির্মাণের সময় তারা এসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ভর্তি না করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তারা।
এমন প্রেক্ষাপটে অনেক অভিভাবক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভরসা রাখেন। তবে সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয়ে প্রায়ই এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও শিক্ষকদের রাজপথে নামতে হয়। গত ২৯ মার্চ রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে মানববন্ধন করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন পরিচালিত ৭২টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে কর্মরত নন বিএসএড শিক্ষকরা। শিক্ষকরা জানান, ২০১৯ সালের বিশেষ শিক্ষা নীতিমালার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে তাদের বেতন-ভাতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে বেতন-ভাতা পুরোপুরি স্থগিত করা হয়।
অন্যদিকে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্মিত স্কুলগুলোর স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তির দাবিতে কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সমিতির নেতা মো. মোস্তাফিজুর রহমান জুয়েল বলেন, নীতিমালার বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিশেষায়িত ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। শিক্ষকরা বেতনহীন হয়ে আছেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা ছাড়া প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, সরকার প্রতিবন্ধী স্কুলগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার পর রাতারাতি অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। এগুলো বাদ দিতে আমরা একটি সার্ভে করছি। যে স্কুলগুলো পুরনো এবং দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে পাঠদান দিয়ে যাচ্ছে, এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। ধীরে ধীরে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ‘শারীরিক বা মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, কিংবা বিকাশ প্রক্রিয়ায় বা সংবেদনশীলতায় প্রতিবন্ধিতা অথবা ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত বা পরিবেশগত প্রতিকূলতার প্রভাবের কারণে কোনো ব্যক্তির দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী অক্ষমতা, যা ব্যক্তিকে সমাজে সমানভাবে সম্পূর্ণ এবং কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয় এমন অবস্থাকে প্রতিবন্ধিতা বলা হয়।’