কাচের পাত্র (ফ্লোরে) মেঝেতে পড়ে গেলে শত শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ও বিভক্ত হয়ে যায়। টুকরোগুলো নানান আকার ধারণ করে। কোনোটা বড়, কোনোটা ছোট আবার কোনোটা অতিক্ষুদ্র। তবে প্রত্যেকের অধিকার থাকে ওই কাচের অংশ বলে পরিচয় দেবার। কোনো এককালে ওই পাত্রটি বড়ই উপকারের ছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ওগুলো ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হবার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
কোনো দরদিজনা যদি খন্ডিতাংশগুলো জড়ো করে ওভেনে ফেলে দেয় এবং সবগুলো গলে গিয়ে নতুন পাত্রে রূপ লাভ করে, তবে পুনরায় কাজে আসবে। বর্তমানকার মানবকুল বহুধাবিভক্ত। আপাতদৃষ্টে মনে হবে, বংশের দিক দিয়ে, কারো সাথে কারো কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ধর্মীয় বিভক্তি, রাজনৈতিক বিভক্তি, কৌলিন্যের বিভক্তি, যতো প্রকারের বিভক্তি বর্তমান বিশ্বে মানুষের মধ্যে দৃষ্ট হয়, মৌলিক জ্ঞান না থাকলে, কেউ বুঝতেই পারবে না, এ শতধাবিভক্তি মানুষগুলো আসলে একজন মানুষ থেকে হয়েছে সৃষ্ট।
আল্লাহপাক, নিজের সুরতে, একজন মানুষ সৃষ্টি করলেন, রূপ গুণে, প্রজ্ঞা ধার্মিকতায়, ঐশী ধনে তাকে স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। God created man in His own image (IMAGE) তাঁকে রাখা হয়েছিল এদন কাননে। ফেরেশতাকুল তাঁকে সেজদা দেবার জন্য হলো আদিষ্ট। মানুষ সৃষ্টির বর্ণনা ঐশী গ্রন্থসমূহে অধিকতর অভিন্ন। মানুষের সাথে পূতপবিত্র মাবুদের ছিল ঘনিষ্ট যোগাযোগ। চলত তাঁদের মধ্যে নিত্যদিন আলাপচারিতা। সে এক মধুর সম্পর্ক। পিতা-পুত্রের মধ্যে যেমন অবাধ-অবিরত ভক্তি-শ্রদ্ধা-স্নেহের বাঁধন থাকে, তদ্রƒপ আদম এবং পূতপবিত্র মাবুদের মধ্যে ততোধিক মধুময়, প্রাঞ্জল সম্পর্ক ছিল বিরাজমান। বর্তমান বিশ্বে প্রাপ্ত অধিকাংশ ঐশী গ্রন্থে, সৃষ্টি রহস্য, বহুলাংশে মৌল বিষয়ে সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যাবে।
অভিশপ্ত শয়তানের কুচক্রে আদম অবাধ্য হয়ে বিতাড়িত হলেন পূতপবিত্র বাগান থেকে। অবাধ্যতার রক্ত বইতে শুরু করল তার ঔরসের সন্তানদের মধ্যেও, যার ইমিডিয়েট অর্থাৎ তাৎক্ষণিক কুফল দেখতে পাই ভ্রাতৃঘাতী কর্মকাÐের মাধ্যমে, কাবিলের হাতে হাবিল হলো নিহত।
গোটা বিশ্ববাসী আজ চরমভাবে কলুষিত, দুর্নীতিপরায়ণ, ঐশী পরিকল্পনার বানচালকারী এক অপশক্তি। সর্পাঘাতে আক্রান্ত ব্যক্তির গোটা শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে এবং ওই ব্যক্তিটি বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে মারাও যায়, তদ্রুপ বর্তমান বিশ্বের কোনো একটা এলাকা পাবেন না খুঁজে, যেথা দূষণ পৌঁছেনি। গোটা বিশ্ব পাপ ও অমানিশার সাগরে ডুবে ডুবে শেষ হচ্ছে। এদের কারো পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না নিজেকে বাঁচানোর। তাদের কাছে কালাম ঘোষণা করা হয়েছে, নিজেদের অবস্থান, আঁচ করার জন্য। পবিত্র খোদার সাথে পুনর্মিলনের জন্য যে সকল শর্তাবলি নবী-রাসুলগণ ঘোষণা করেছেন তা তারা জানতে পেরেছে এবং এও বুঝতেও পেরেছে, পতিত মানুষের নিজেদের উদ্ভাবিত পথে, নাজাত বা মুক্তির পথ প্রস্তুত করা আদৌ সম্ভব নয়। মানুষকে আজ পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে প্রাপ্ত ধর্মীয় নিয়ম-কানুন পালনের দ্বারা পাপ ও শয়তানের কবল থেকে মুক্তিলাভ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রত্যেকটি মানুষ অসহায়। সকলে কলুষিত, পদানত। আদমের ঔরস থেকে যতজন জন্মগ্রহণ করেছে, তারা সকলেই পাপী। বাঘের স্বভাব নিয়ে ব্যাঘ্রছানা যেমন জন্মলাভ করে, তদ্রুপ মানবীয় স্বভাব নিয়ে প্রত্যেকটি মানবাশিশু ভূমিষ্ঠ হয়। সে কারণেই, কবির ভাষায় বলা হয়েছে ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ পৃথিবী ও তদীয় বস্তুজগত, মানুষের নাজাতের জন্য আদৌ কোনো ক্ষমতা রাখে না। তাছাড়া মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন করার মতো ক্ষমতাও পৃথিবীতে নেই। একটি অপরিবর্তিত মানুষ যতই পরামর্শ দিক না কেন, ও সকল পরামর্শ শূন্যে বিলীন হতে বাধ্য। পাপ ও দিয়াবলের করাল গ্রাস থেকে মানুষকে বাঁচাতে চাই ঐশী ক্ষমতা, কেবল মহাপরাক্রান্ত খোদার হস্তক্ষেপ। রহম দিলো আল্লাহপাক মানুষের এহেন করুণদশা থেকে রক্ষা করার জন্য আর একজন ঐশী মানব পাঠালেন পতিত ধরাপৃষ্ঠে, যেনো, তিনি মানুষের কৃত পাপের কাফফারা পরিশোধ করে তাদের তুলে আনতে পারেন খোদার দরবারে। মাবুদ, নিজের পাকরূহকে, মানুষের সুরতে জগতে পাঠালেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন বেগুনাহ ঈসা কালেমাতুল্লাহ। আল্লাহপাকের জীবন্ত কালাম, মানবরূপে ভূপৃষ্টে হলেন আবির্ভূত, কেবল মানুষের নাজাতের জন্য। ব্যর্থ মানুষ, কেবল খোদার রহমতে, পের নাজাতের অবারিত দুয়ার। যারা আপনাকে ধর্মকর্মের শিক্ষা দেয়, তারা আপনাকে যে কতটা ভালোবেসে ওই শিক্ষা দিচ্ছে, তাতে বেশ সন্দেহ আছে। তবে নিঃসন্দেহে বলতে হবে, শিক্ষকগণ এ প্রক্রিয়ার দ্বারা অবশ্যই হচ্ছে লাভবান। ধার্মিকতা ও আনুষ্ঠানিকতা প্রবন্ধে এ বিষয়ে আমি বিষদ আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া ‘ধর্ম ও বর্জ্য’ নামক প্রবন্ধেও উল্লেখ করেছি, পৃথিবীর কোনো কিছুই ধার্মিকতার উৎস নয়। যারা পার্থিব বস্তুর মধ্যে ধার্মিকতা খুঁজে ফিরছে, তারা কেবল পÐশ্রমে অর্থ ও সময় নষ্ট করছে।
ধার্মিকতা আল্লাহপাকের নিজস্ব গুণ ও সম্পদ! তিনি নিজেকে পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ করেছেন ঈসা রুহুল্লাহর মাধ্যমে। যে ওই মসিহকে দেখেছে, সেই আল্লাহকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। ‘মসিহই অদৃশ্য আল্লাহপাকের হুবহু প্রকাশ’ কথাটা যদি মেনে নিতে কষ্ট হয় তবে পতিত আদমের ঔরস থেকে জন্মপ্রাপ্ত আর একজনকে নিয়ে আসুন, যে কিনা বেগুনাহ। অসম্ভব!
সকলে পাপ করেছে এবং খোদার গৌরব নষ্ট করেছে। মানুষের রক্তে মানুষের হাত হয়েছে ও হচ্ছে রঞ্জিত। কথার সাথে কাজের দূরত্ব আকাশ-পাতালের দূরত্বের চেয়েও অধিক। পূতপবিত্র মানুষ হয়ে পড়েছে চূড়ান্তভাবে কলুষিত, হয়ে পড়েছে অভিশপ্ত ইবলিসের দোসর।
তারপরও বলতে হবে, মানুষের মধ্যে একটা শুপ্ত বাসনা রয়েছে পূতপবিত্র হবার, পরস্পরকে প্রেম করার, পরস্পরের সান্বিধ্যলাভের। এক্ষেত্রে মানুষের বিবেক রয়েছে সক্রিয়। লণ্ঠন দেখেছেন অনেকেই, লণ্ঠনে থাকে কাচের চিমনি। লণ্ঠনটি যখন গোটা রাত্রি জ্বলতে থাকে, তখন ধোঁয়া সৃষ্টি করে স্বচ্ছ চিমনিটিকে অস্বচ্ছ করে তোলে, ফলে যথাযথ আলো ছড়াতে পারে না। তখন ওই কাচের চিমনিটিকে পরিষ্কার করে দিতে হয়, যাতে পুনরায় পূর্বের মতো উজ্জ্বল আলো ছড়াতে পারে। মানুষের মধ্যে যে বিবেক ও ঐশী আহ্বান কাজ করে, পার্থিব গোলকধাঁধায়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণে, অস্বচ্ছ হয়ে থাকে। পাক কালাম হলো এমন এক ঐশী শক্তি, যার প্রয়োগে, সর্বপ্রকার ধোঁয়ার আবরণ দূর হয়ে যায়, তখন মানুষ, নতুনভাবে খোদাকে দেখতে পারে। আল্লাহ মহান, পূতপবিত্র প্রেমের আঁধার, যিনি মসিহের মাধ্যমে গোটা বিশ্ববাসী নতুনভাবে গড়ে তুলেছেন। ঈমানদারগণ আল্লাহওয়ালা বা আল্লাহপাকের রুহানি সন্তান হিসেবে বিবেচিত। পাক কালাম থেকে একটি অংশ তুলে দেয়া হলো, ‘ঈসা মসিহের ওপর ইমানের মধ্যেদিয়ে তোমরা সবাই আল্লাহর সন্তান হয়েছে, কারণ তোমাদের যাদের মসিহের মধ্যে তরিকাবন্দি হয়েছে, তোমরা কাপড়ের মতো করে মসিহকে দিয়ে নিজেদের ঢেকে ফেলেছ। ইহুদি ও অইহুদির মধ্যে, গোলাম ও স্বাধীন লোকের মধ্যে, স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই, কারণ ঈসা মসিহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তোমরা সবই এক হয়েছ। তোমরা যখন মসিহের হয়েছ তখন ইব্রাহীমের বংশধরও হয়েছ। আর আল্লাহ যা দেবার ওয়াদা ইব্রাহীমের কাছে করেছিলেন তোমরাও সেই সবের অধিকারী হয়েছ। (গালাতীয় ৩ : ২৬-২৯)