পাক-কালামের আলোকে আমাদের অবস্থান হলো, আমরা সকলে আদমের সন্তান-সন্তুতি!
পরম করুনাময় আল্লাহপাক বিমূর্ত এক মহান সত্তা, মানুষ তাকে দেখতে পাবার কথা নয়, কেননা যিনি রুহানি সত্ত্বা নিয়ে আছেন প্রেম পবিত্রতা ধার্মিকতার শীর্ষে তাকে তো মানুষ দেখতে পায় না। মানুষের মধ্যে যে সকল গুনাবলি রয়েছে তাও তো কেউ দেখতে পায় না, তা সত্তে¡ও মানুষকে তার স্বভাব আচরণের মাধ্যমে নানা উপাধি দিয়ে থাকি। যেমন প্রেমিক ব্যক্তি। বলুন, আপনি কি কখনো প্রেম দেখেছেন, কেবল প্রেমমন্ডিত আচরণ দেখে আপনি তাকে প্রেমিক বলে উপাধি দিলেন। আবার একইভাবে কারো খারাপ আচরণ দেখে তাকে তেমন নামে চিহ্নিত করে নিলেন।
সৃষ্টিলগ্নে মহব্বতের পারাবার মাবুদ মাওলা একজন মানুষ সৃষ্টি করে তাকে তাঁর স্বীয় গুনাবলি দিয়ে সাজিয়ে দিলেন, যেন তার স্বভাব আচরণ দেখে তাঁর মাধ্যমে সকলে খোদার পরিচয় লাভ করতে পারে। আর সে জন্যই বলা হয়, খোদা নিজ সুরতে প্রথম মানুষ আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করলেন। আদমের সুযোগ্য স্ত্রী বিবি হাওয়াকে খোদাই সৃষ্টি করলেন, অবশ্য আদমের এক খন্ড হাড় দিয়ে তাঁকে সৃষ্টি করে উভয়কে সংসার রচনা করার ক্ষমতায় পূর্ণ করলেন। তাদের বসবাস করার জন্য একটি সুরম্য বাগানবাড়ি বরাদ্দ করে দিলেন। ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের জন্য যাবতীয় ফল-ফলাদি খাদ্য পানেয় সৃষ্টি করে দিলেন…।
তারা উভয় মহা সুখেই জীবন যাপন করে চলছিলেন। মানুষের এহেন সুখ অভিশপ্ত ইবলিসের সহ্য হবার কথা নয়। ইবলিসের পতন ঘটেছে আদমকে সেজদা না দেবার কারণে, বলা বাহুল্য, খোদা নিজেই তাকে হুকুম দিয়েছিলেন আদমকে সেজদা দেবার জন্য। অহংকারের বশবর্তী হয়ে খোদার হুকুম অগ্রাহ্য করলো, আর তার পরিণতি হলো আজীবনের জন্য অভিশপ্ত। তাই স্বাভাবিক কারণে মানুষের সুখ শান্তি ইবলিসের সহ্য হবার কথা হতে পারে না।
অন্যদিকে আদমকে আমরা দেখব, দেখব তাঁর মন-মানসিকতা, কেননা ঐ আদমের বংশধর হলাম আমরা গোটা বিশ্ববাসি। ইবলিস যখন এসে আদম হাওয়াকে খোদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে প্ররোচিত করলো, তখন আদম হাওয়াকে বুঝতে হতো, কে তাদের এতটা মহব্বত করেন, কে তাদের সৃষ্টি করেছেন, বসবাসের জন্য সুরম্য বাগানবাড়ি দান করেছেন, নিত্যদিন খোজ-খবর নিচ্ছেন ও কল্যাণমুখী সবকটা কাজ করে চলছেন। প্রকৃতার্থে আদম তো কিছুই সৃষ্টি করেন নি যা কিছু উপভোগ করে চলছিলো। আর অভিশপ্ত ইবলিস তাদের কুমন্ত্রণা দিচ্ছে কোন অধিকারে, কোন উদ্দেশ্যে, ইবলিসের দ্বারা তো তাদের কোনো উপকার হবার ছিল না বা নেই। তবুও ইবলিসের মিথ্যা প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে পড়লেন আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম হাওয়া। আগেই বলেছি, আমরা হলাম তাদের গর্বিত বংশধর! আমরা তাই সহজেই ইবলিসের কুটচালে রাজি হয়ে যাই, খোদা বিরোধি অপকর্মে ডুবে যাই, যে প্রবণতা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
আমরা জানি ও মানি, মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির স্রেষ্ঠ জীব। খোদার যোগ্য প্রতিনিধি! যদিও মানুষের পতন ঘটেছে, প্রতারিত হয়েছে, ইবলিসের চালে ও জালে বন্দি হয়ে পড়েছে, তবুও খোদ মাবুদ, মানুষের নির্মাতা জানেন তাদের ফিরিয়ে নেবার উত্তম কৌশল। এই মানুষ যখন ইবলিসকে সম্যকভাবে বুঝতে পারবে, অমনি ঝাটা মেরে তাড়িয়ে দিবে, যে কথা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা চলে।
ছোট্ট একটা দৃষ্টান্ত দেব, ক্লান্ত হবেন না পাঠক বর্গ। যে কোনো আলেম বা ওয়ায়েজিন ওয়াজ করতে দাঁড়ান, অমনি সর্বপ্রথম যে কথাটি বলেন তা হলো, আউজুবিল্লাহ… যার অর্থ হলো অভিশপ্ত ইবলিসের দাগা বা ধোকা থেকে বাঁচার জন্য (মাবুদের) কাছে আশ্রয় কামনা করছি। অবশ্য প্রতিটি কাজ করার পূর্ব মুহুর্তে আমাদের সকলকে এমন প্রার্থনা করা আবশ্যক। আদম যদি এমন দোয়া পড়তেন তবে হয়তো ইবলিসকে বিতাড়িত করতে পারতেন।
মজার বিষয় হলো, মানুষ নিজে নিজে এমন কোনো প্রজ্ঞা, ধার্মিকতা বা শক্তি অধিকার রাখে না, যার বলে সে ইবলিসকে পরাভূত করতে পারবে, তবে কোনো ব্যক্তি যখন খোদার শক্তিতে থাকে শক্তিমান, তখন তার পক্ষে সবকিছুই সাধন করা সম্ভব।
বিদ্যুৎ প্রবাহিতার স্পর্শ করলে মানুষ মারা যেতে পারে অথবা ছিটকে যায়, তা ভাববেন না, ওটা তারের শক্তি, আসলে উক্ত তারের মধ্য দিয়ে যে তরিৎপ্রবাহিত হচ্ছে, ধাক্কা মারার শক্তি উক্ত তরিতের, তারের নয়। একইভাবে মানুষ অপশক্তি ইবলিসকে ঠিক তখনই তাড়াতে পারে যখন উক্ত ব্যক্তি খোদার শক্তিতে অর্থাৎ পাকরূহের দ্বারা অভিশিক্ত থাকে।
যার মধ্যে খোদার রূহ বাস করে, যে ব্যক্তি পাকরূহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত থাকে, তার দ্বারা কষ্মিণকালেও মানুষের ক্ষতি প্রত্যাশা করা সম্ভব নয়। পরমকরুনাময় খোদা মানুষের জন্য কোনো ক্ষতি বা বিপদ ডেকে আনেন না, তাঁর পরিকল্পনা হলো কেবল কল্যাণ আর কল্যাণ। মানুষকে তিনি নিজের মত প্রেম করেন, মানুষ এতটাই খারাপ ও বিগড়ে যাওয়া, তবুও তাদের প্রতি রয়েছে খোদার অসীম মহব্বত। পাককালামে যথার্থ বর্ণীত রয়েছে; মানুষকে পাপ ও ইবলিসের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি এক চূড়ান্ত মুল্য পরিশোধ দিলেন স্বীয় কালাম ও পাকরূহ মানুষের রূপে জগতে প্রেরণের মাধ্যমে, যিনি মানুষের কৃত পাপের কাফফারা শোধ দিলেন স্বীয় পূতপবিত্র রক্তের মূল্যে। প্রেমের পরাকাষ্টা এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে।
বর্তমান বিশ্ব তথা প্রথম নর-নারী আদম-হাওয়ার এদন কানন থেকে বিতাড়িত হবার সময় থেকে পরিষ্কার প্রমান রয়েছে, ভাই ভাইকে কতল করে হয়েছে অভিশপ্ত। বিশ্বের প্রত্যেকটি কর্মকান্ডের দিকে নজর দিলে প্রমাণিত, সকল মানুষ পরিচালিত হচ্ছে অভিশপ্ত ইবলিসের নিয়ন্ত্রণে। আর ইবলিসের কাজ হলো চুরি, খুন ও নষ্ট করা। খোদার সুমহান পরিকল্পনা বানচাল না করা পর্যন্ত ইবলিস শান্তি পেতে পারে না। যে মন্ত্রে মানুষের ক্ষতি হয় তা কেবল ইবলিসের রচনা যা আমরা এদন উদ্যান থেকে দীক্ষা নিয়েছি।
মানুষের কল্যাণ সাধন কেবল মহান খোদার দায়িত্ব। সবকিছু ধ্বংস হওয়ার পরেও মাবুদের পক্ষে নতুনভাবে আবার গড়ে তোলা সম্ভব। নতুন আকাশ ও নতুন পৃথিবী তিনিই পুনরায় সৃষ্টি করবেন, সে ব্যবস্থা পরিষ্কার বর্ণীত রয়েছে পাককালামে। মানুষ অমর! মানুষের রয়েছে একটি ভৌতিক দেহ যা মরণশীল, মাটি দ্বারা তৈরি যা কিছু তা মাটিতে মিশে যাবে। এ দেহটিকে খেয়া তরীর সাথে তুলনা করা হলে অতিরঞ্জন করা হবে না। যেমন জন্ম ও মৃত্যু একটি নদীর দুটি তীর, আর মাঝের সময়টা হলো এপার থেকে ঐ পারে কালরূপ বহমান নদী যা পাড়ী জমানো। এই সময়টা এক একজনের জন্য এক এক সময় হয়ে থাকে। যে আত্মা বা রুহটি আদমের নাশিকায় খোদা ফুকে দিলেন তাকে আমরা প্রাণ বায়ু বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। খোদার রূহ দেহ থেকে মুক্তি পাবার সাথে সাথে পুনরায় খোদার কাছে ফিরে যায়। পিছনে পড়ে থাকে মাটির দেহ!
খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহকে যখন সলিবে হত্যা করেছিল, তখন তাঁর দুইপাশে দুইজন দোষী ব্যক্তিকেও সলিববিদ্ধ করে মেরেছিল। মৃত্যুর পূর্বে মসিহের ডান পাশের ব্যক্তিটি মসিহকে অনুরোধ জানিয়েছিল, মসিহ যখন বেহেশতে যাবেন তখন যেন তার কথা স্মরণ করেন। উত্তরে মসিহ তাকে বলেছিলেন, ‘অদ্যই তুমি আমার সাথে পরমদেশে যাবে।’
মসিহ জগতে এসেছেন গুনাহে লিপ্ত ধোকা খাওয়া ব্যক্তিদের গুনাহ ও ইবলিসের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য। যা কিছু হারিয়ে গেছে তা খুঁজে ফেরার জন্যই মসিহের আগমন ঘটেছে এ পতিত ধরা তলে।
যদিও আমাদের অবস্থান বড়ই শোচনীয়, অতীব করুন, তা সত্তে¡ও আমাদের রয়েছে অভাবিত সুযোগ, সুযোগ মন পরিবর্তনের, নিজেদের খোদার হাতে তুলে দেবার জন্য; যেমন গানে আছে, ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না।’ সত্যিই আজ আমরা পর্যুদস্থ, চরমাকারে! পাককালামে তাই যথার্থ পরামর্শ রয়েছে, “তোমাদের সব ভাবনা তাঁর উপর সপে দাও, অন্যত্র রয়েছে “তোমরা যারা পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত…” মানুষের পাপের কাফফারা পরিশোধ করার হন্য খোদার পুত্র খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহ স্বীয় পূতপবিত্র প্রাণ দিলেন কোরবান, যা ছিল মানুষের জন্য একমাত্র মুক্তির উপায়, তাছাড়া গুনাহগার মানুষের মুক্তির জন্য কাফফারা শোধ দেবার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট ছিল না।
জন্মসূত্রে বলুন আর কর্মসূত্রে বলুন, সকল মানুষ যেমন আদমজাত, একইভাবে সকলেই গুনাহগার। সকলে পাপ করেছে এবং বর্তমানেও নিরবধি করে চলছে। মানুষের পাপের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। গোটা বিশ্ব কলুষিত, অর্থাৎ বিশ্বের সকল লোক কলুষিত। মানুষের কর্ম ও চরিত্র তা প্রমান করার জন্য যথেষ্ট।
ধর্মীয় বিধিবিধান বা দশ শরীয়তের আলোকে মানুষের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা পরিষ্কার ধরা পড়ে। খোদার স্থলে অন্য কোনো দেবতা দাঁড় করানো চলবে না
হিজরত ২০ : ৩ আমার জায়গায় কোনো দেবতাকে দাঁড় করাবে না (মথি ৪ : ১০)
২০ : ৪ পূজার উদ্দেশ্যে তোমরা কোনো মূর্তি তৈরি করবে না (লুক ১৬ : ১৩)
২০ : ৭ কোনো বাজে উদ্দেশ্যে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহর নাম নিবে না (মথি ৫ : ৩৪)
২০ : ৮ বিশ্রামবার পবিত্র করে রাখবে এবং তা পালন করবে (মার্ক ২ : ২৭, ২৮)
২০ : ১২ তোমাদের পিতামাতাকে সম্মান করে চলবে (মথি ১০ : ৩৭)
২০ : ১৩ খুন করো না (মথি ৫ : ২২)
২০ : ১৪ জেনা করো না (মথি ৫ : ২৪)
২০ : ১৫ চুরি করো না (মথি ৫ : ৪০)
২০ : ১৬ কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ো না (মথি ১২ : ৩৬)
২০ : ১৭ অন্যের ঘর-দুয়ার, স্ত্রী, গোলাম ও বাঁদী গরু,গাধা কিংবা আর কিছুর উপর লোভ করো না। লুক ১২ : ১৫
এবার দিবালোকের মতো পরিষ্কার হলো আমাদের অবস্থান আমাদের কাছে এবং খোদার নজরে; আমরা পরিষ্কার গুনাহগার। না আছে ধার্মিকতা, না আছে পবিত্রতা, আছে ভরপুর কেবল পাপ কালিমায়। আমরা স্বভাবগত কারণে বড়ই স্বার্থান্ধ, নিজের সুবিধেটুকু আদায় করার ক্ষেত্রে ন্যায় অন্যায় গুলিয়ে ফেলতেও কোনো আপত্তি নেই, তা যাত্রারম্ভে প্রমাণ করে এসেছি। তবে আমাদের হৃদয় ও বিবেক গোপনে অভিযোগ করে চলছে, বিবেকের দংশন থেকে আমরা কেউই রেহাই পাই না, তা হলফ করে বলতে পারি।
অন্তর্জালা আমাদের নিয়ত অনুরোধ জানাচ্ছে পূতপবিত্র মসিহের কাছে ছুটে যেতে, কিন্তু সমাজকে আমরা বড়ই ভয় পাই। বোধকরি ফরিসিদের নেতা নিকদিম তাই রাতের আঁধারে মসিহের কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন, ঐশি বিষয় নিয়ে। মসিহ তাকে ‘নতুন জন্মের বিষয় বলেছিলেন, কিন্তু নিকদিমের মতো সুপন্ডিত ব্যক্তির পক্ষেও নতুন জন্মের বিষয় ছিল প্রচ্ছন্ন। মাংস থেকে যা কিছু জাত তা অবশ্যই মাংসিক আর আত্মার দ্বারা যা জন্মলাভ করে অবশ্যই তা আত্মিক।
অবশ্যই আদমের বংশজাত বলে আমরা পাপ ও গুনাহের মধ্যে জীবন-যাপন করে চলছি! চাই আমাদের নতুন জন্ম লাভ, যা একমাত্র খোদার রূহ ও কালাম যা মানুষের রূপে জগতে আগমন করেছেন, আমাদের পাপের কাফফারা পরিশোধ করেছেন, আমাদের মুক্তি দিলেন, কেবল তাঁর মধ্য দিয়েই ঘটেছে আমাদের অনন্ত আজাদি, পিতার সাথে পুনর্মিলনের এক অপূর্ব অভাবিত সুযোগ, যা কেবল খোদার অশেষ রহমতে হয়েছে সাধিত, আমাদের জন্য বিনামুল্যে দত্ত (ইফিষীয় ২ ঃ ৮-১০)।
পরম করুনাময় আল্লাহপাক বিমূর্ত এক মহান সত্তা, মানুষ তাকে দেখতে পাবার কথা নয়, কেননা যিনি রুহানি সত্ত্বা নিয়ে আছেন প্রেম পবিত্রতা ধার্মিকতার শীর্ষে তাকে তো মানুষ দেখতে পায় না। মানুষের মধ্যে যে সকল গুনাবলি রয়েছে তাও তো কেউ দেখতে পায় না, তা সত্তে¡ও মানুষকে তার স্বভাব আচরণের মাধ্যমে নানা উপাধি দিয়ে থাকি। যেমন প্রেমিক ব্যক্তি। বলুন, আপনি কি কখনো প্রেম দেখেছেন, কেবল প্রেমমন্ডিত আচরণ দেখে আপনি তাকে প্রেমিক বলে উপাধি দিলেন। আবার একইভাবে কারো খারাপ আচরণ দেখে তাকে তেমন নামে চিহ্নিত করে নিলেন।
সৃষ্টিলগ্নে মহব্বতের পারাবার মাবুদ মাওলা একজন মানুষ সৃষ্টি করে তাকে তাঁর স্বীয় গুনাবলি দিয়ে সাজিয়ে দিলেন, যেন তার স্বভাব আচরণ দেখে তাঁর মাধ্যমে সকলে খোদার পরিচয় লাভ করতে পারে। আর সে জন্যই বলা হয়, খোদা নিজ সুরতে প্রথম মানুষ আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করলেন। আদমের সুযোগ্য স্ত্রী বিবি হাওয়াকে খোদাই সৃষ্টি করলেন, অবশ্য আদমের এক খন্ড হাড় দিয়ে তাঁকে সৃষ্টি করে উভয়কে সংসার রচনা করার ক্ষমতায় পূর্ণ করলেন। তাদের বসবাস করার জন্য একটি সুরম্য বাগানবাড়ি বরাদ্দ করে দিলেন। ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের জন্য যাবতীয় ফল-ফলাদি খাদ্য পানেয় সৃষ্টি করে দিলেন…।
তারা উভয় মহা সুখেই জীবন যাপন করে চলছিলেন। মানুষের এহেন সুখ অভিশপ্ত ইবলিসের সহ্য হবার কথা নয়। ইবলিসের পতন ঘটেছে আদমকে সেজদা না দেবার কারণে, বলা বাহুল্য, খোদা নিজেই তাকে হুকুম দিয়েছিলেন আদমকে সেজদা দেবার জন্য। অহংকারের বশবর্তী হয়ে খোদার হুকুম অগ্রাহ্য করলো, আর তার পরিণতি হলো আজীবনের জন্য অভিশপ্ত। তাই স্বাভাবিক কারণে মানুষের সুখ শান্তি ইবলিসের সহ্য হবার কথা হতে পারে না।
অন্যদিকে আদমকে আমরা দেখব, দেখব তাঁর মন-মানসিকতা, কেননা ঐ আদমের বংশধর হলাম আমরা গোটা বিশ্ববাসি। ইবলিস যখন এসে আদম হাওয়াকে খোদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে প্ররোচিত করলো, তখন আদম হাওয়াকে বুঝতে হতো, কে তাদের এতটা মহব্বত করেন, কে তাদের সৃষ্টি করেছেন, বসবাসের জন্য সুরম্য বাগানবাড়ি দান করেছেন, নিত্যদিন খোজ-খবর নিচ্ছেন ও কল্যাণমুখী সবকটা কাজ করে চলছেন। প্রকৃতার্থে আদম তো কিছুই সৃষ্টি করেন নি যা কিছু উপভোগ করে চলছিলো। আর অভিশপ্ত ইবলিস তাদের কুমন্ত্রণা দিচ্ছে কোন অধিকারে, কোন উদ্দেশ্যে, ইবলিসের দ্বারা তো তাদের কোনো উপকার হবার ছিল না বা নেই। তবুও ইবলিসের মিথ্যা প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে পড়লেন আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম হাওয়া। আগেই বলেছি, আমরা হলাম তাদের গর্বিত বংশধর! আমরা তাই সহজেই ইবলিসের কুটচালে রাজি হয়ে যাই, খোদা বিরোধি অপকর্মে ডুবে যাই, যে প্রবণতা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
আমরা জানি ও মানি, মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির স্রেষ্ঠ জীব। খোদার যোগ্য প্রতিনিধি! যদিও মানুষের পতন ঘটেছে, প্রতারিত হয়েছে, ইবলিসের চালে ও জালে বন্দি হয়ে পড়েছে, তবুও খোদ মাবুদ, মানুষের নির্মাতা জানেন তাদের ফিরিয়ে নেবার উত্তম কৌশল। এই মানুষ যখন ইবলিসকে সম্যকভাবে বুঝতে পারবে, অমনি ঝাটা মেরে তাড়িয়ে দিবে, যে কথা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা চলে।
ছোট্ট একটা দৃষ্টান্ত দেব, ক্লান্ত হবেন না পাঠক বর্গ। যে কোনো আলেম বা ওয়ায়েজিন ওয়াজ করতে দাঁড়ান, অমনি সর্বপ্রথম যে কথাটি বলেন তা হলো, আউজুবিল্লাহ… যার অর্থ হলো অভিশপ্ত ইবলিসের দাগা বা ধোকা থেকে বাঁচার জন্য (মাবুদের) কাছে আশ্রয় কামনা করছি। অবশ্য প্রতিটি কাজ করার পূর্ব মুহুর্তে আমাদের সকলকে এমন প্রার্থনা করা আবশ্যক। আদম যদি এমন দোয়া পড়তেন তবে হয়তো ইবলিসকে বিতাড়িত করতে পারতেন।
মজার বিষয় হলো, মানুষ নিজে নিজে এমন কোনো প্রজ্ঞা, ধার্মিকতা বা শক্তি অধিকার রাখে না, যার বলে সে ইবলিসকে পরাভূত করতে পারবে, তবে কোনো ব্যক্তি যখন খোদার শক্তিতে থাকে শক্তিমান, তখন তার পক্ষে সবকিছুই সাধন করা সম্ভব।
বিদ্যুৎ প্রবাহিতার স্পর্শ করলে মানুষ মারা যেতে পারে অথবা ছিটকে যায়, তা ভাববেন না, ওটা তারের শক্তি, আসলে উক্ত তারের মধ্য দিয়ে যে তরিৎপ্রবাহিত হচ্ছে, ধাক্কা মারার শক্তি উক্ত তরিতের, তারের নয়। একইভাবে মানুষ অপশক্তি ইবলিসকে ঠিক তখনই তাড়াতে পারে যখন উক্ত ব্যক্তি খোদার শক্তিতে অর্থাৎ পাকরূহের দ্বারা অভিশিক্ত থাকে।
যার মধ্যে খোদার রূহ বাস করে, যে ব্যক্তি পাকরূহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত থাকে, তার দ্বারা কষ্মিণকালেও মানুষের ক্ষতি প্রত্যাশা করা সম্ভব নয়। পরমকরুনাময় খোদা মানুষের জন্য কোনো ক্ষতি বা বিপদ ডেকে আনেন না, তাঁর পরিকল্পনা হলো কেবল কল্যাণ আর কল্যাণ। মানুষকে তিনি নিজের মত প্রেম করেন, মানুষ এতটাই খারাপ ও বিগড়ে যাওয়া, তবুও তাদের প্রতি রয়েছে খোদার অসীম মহব্বত। পাককালামে যথার্থ বর্ণীত রয়েছে; মানুষকে পাপ ও ইবলিসের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি এক চূড়ান্ত মুল্য পরিশোধ দিলেন স্বীয় কালাম ও পাকরূহ মানুষের রূপে জগতে প্রেরণের মাধ্যমে, যিনি মানুষের কৃত পাপের কাফফারা শোধ দিলেন স্বীয় পূতপবিত্র রক্তের মূল্যে। প্রেমের পরাকাষ্টা এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে।
বর্তমান বিশ্ব তথা প্রথম নর-নারী আদম-হাওয়ার এদন কানন থেকে বিতাড়িত হবার সময় থেকে পরিষ্কার প্রমান রয়েছে, ভাই ভাইকে কতল করে হয়েছে অভিশপ্ত। বিশ্বের প্রত্যেকটি কর্মকান্ডের দিকে নজর দিলে প্রমাণিত, সকল মানুষ পরিচালিত হচ্ছে অভিশপ্ত ইবলিসের নিয়ন্ত্রণে। আর ইবলিসের কাজ হলো চুরি, খুন ও নষ্ট করা। খোদার সুমহান পরিকল্পনা বানচাল না করা পর্যন্ত ইবলিস শান্তি পেতে পারে না। যে মন্ত্রে মানুষের ক্ষতি হয় তা কেবল ইবলিসের রচনা যা আমরা এদন উদ্যান থেকে দীক্ষা নিয়েছি।
মানুষের কল্যাণ সাধন কেবল মহান খোদার দায়িত্ব। সবকিছু ধ্বংস হওয়ার পরেও মাবুদের পক্ষে নতুনভাবে আবার গড়ে তোলা সম্ভব। নতুন আকাশ ও নতুন পৃথিবী তিনিই পুনরায় সৃষ্টি করবেন, সে ব্যবস্থা পরিষ্কার বর্ণীত রয়েছে পাককালামে। মানুষ অমর! মানুষের রয়েছে একটি ভৌতিক দেহ যা মরণশীল, মাটি দ্বারা তৈরি যা কিছু তা মাটিতে মিশে যাবে। এ দেহটিকে খেয়া তরীর সাথে তুলনা করা হলে অতিরঞ্জন করা হবে না। যেমন জন্ম ও মৃত্যু একটি নদীর দুটি তীর, আর মাঝের সময়টা হলো এপার থেকে ঐ পারে কালরূপ বহমান নদী যা পাড়ী জমানো। এই সময়টা এক একজনের জন্য এক এক সময় হয়ে থাকে। যে আত্মা বা রুহটি আদমের নাশিকায় খোদা ফুকে দিলেন তাকে আমরা প্রাণ বায়ু বলে আখ্যা দিয়ে থাকি। খোদার রূহ দেহ থেকে মুক্তি পাবার সাথে সাথে পুনরায় খোদার কাছে ফিরে যায়। পিছনে পড়ে থাকে মাটির দেহ!
খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহকে যখন সলিবে হত্যা করেছিল, তখন তাঁর দুইপাশে দুইজন দোষী ব্যক্তিকেও সলিববিদ্ধ করে মেরেছিল। মৃত্যুর পূর্বে মসিহের ডান পাশের ব্যক্তিটি মসিহকে অনুরোধ জানিয়েছিল, মসিহ যখন বেহেশতে যাবেন তখন যেন তার কথা স্মরণ করেন। উত্তরে মসিহ তাকে বলেছিলেন, ‘অদ্যই তুমি আমার সাথে পরমদেশে যাবে।’
মসিহ জগতে এসেছেন গুনাহে লিপ্ত ধোকা খাওয়া ব্যক্তিদের গুনাহ ও ইবলিসের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য। যা কিছু হারিয়ে গেছে তা খুঁজে ফেরার জন্যই মসিহের আগমন ঘটেছে এ পতিত ধরা তলে।
যদিও আমাদের অবস্থান বড়ই শোচনীয়, অতীব করুন, তা সত্তে¡ও আমাদের রয়েছে অভাবিত সুযোগ, সুযোগ মন পরিবর্তনের, নিজেদের খোদার হাতে তুলে দেবার জন্য; যেমন গানে আছে, ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না।’ সত্যিই আজ আমরা পর্যুদস্থ, চরমাকারে! পাককালামে তাই যথার্থ পরামর্শ রয়েছে, “তোমাদের সব ভাবনা তাঁর উপর সপে দাও, অন্যত্র রয়েছে “তোমরা যারা পরিশ্রান্ত ও ভারাক্রান্ত…” মানুষের পাপের কাফফারা পরিশোধ করার হন্য খোদার পুত্র খোদাবন্দ হযরত ঈসা মসিহ স্বীয় পূতপবিত্র প্রাণ দিলেন কোরবান, যা ছিল মানুষের জন্য একমাত্র মুক্তির উপায়, তাছাড়া গুনাহগার মানুষের মুক্তির জন্য কাফফারা শোধ দেবার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট ছিল না।
জন্মসূত্রে বলুন আর কর্মসূত্রে বলুন, সকল মানুষ যেমন আদমজাত, একইভাবে সকলেই গুনাহগার। সকলে পাপ করেছে এবং বর্তমানেও নিরবধি করে চলছে। মানুষের পাপের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। গোটা বিশ্ব কলুষিত, অর্থাৎ বিশ্বের সকল লোক কলুষিত। মানুষের কর্ম ও চরিত্র তা প্রমান করার জন্য যথেষ্ট।
ধর্মীয় বিধিবিধান বা দশ শরীয়তের আলোকে মানুষের অক্ষমতা ও ব্যর্থতা পরিষ্কার ধরা পড়ে। খোদার স্থলে অন্য কোনো দেবতা দাঁড় করানো চলবে না
হিজরত ২০ : ৩ আমার জায়গায় কোনো দেবতাকে দাঁড় করাবে না (মথি ৪ : ১০)
২০ : ৪ পূজার উদ্দেশ্যে তোমরা কোনো মূর্তি তৈরি করবে না (লুক ১৬ : ১৩)
২০ : ৭ কোনো বাজে উদ্দেশ্যে তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহর নাম নিবে না (মথি ৫ : ৩৪)
২০ : ৮ বিশ্রামবার পবিত্র করে রাখবে এবং তা পালন করবে (মার্ক ২ : ২৭, ২৮)
২০ : ১২ তোমাদের পিতামাতাকে সম্মান করে চলবে (মথি ১০ : ৩৭)
২০ : ১৩ খুন করো না (মথি ৫ : ২২)
২০ : ১৪ জেনা করো না (মথি ৫ : ২৪)
২০ : ১৫ চুরি করো না (মথি ৫ : ৪০)
২০ : ১৬ কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ো না (মথি ১২ : ৩৬)
২০ : ১৭ অন্যের ঘর-দুয়ার, স্ত্রী, গোলাম ও বাঁদী গরু,গাধা কিংবা আর কিছুর উপর লোভ করো না। লুক ১২ : ১৫
এবার দিবালোকের মতো পরিষ্কার হলো আমাদের অবস্থান আমাদের কাছে এবং খোদার নজরে; আমরা পরিষ্কার গুনাহগার। না আছে ধার্মিকতা, না আছে পবিত্রতা, আছে ভরপুর কেবল পাপ কালিমায়। আমরা স্বভাবগত কারণে বড়ই স্বার্থান্ধ, নিজের সুবিধেটুকু আদায় করার ক্ষেত্রে ন্যায় অন্যায় গুলিয়ে ফেলতেও কোনো আপত্তি নেই, তা যাত্রারম্ভে প্রমাণ করে এসেছি। তবে আমাদের হৃদয় ও বিবেক গোপনে অভিযোগ করে চলছে, বিবেকের দংশন থেকে আমরা কেউই রেহাই পাই না, তা হলফ করে বলতে পারি।
অন্তর্জালা আমাদের নিয়ত অনুরোধ জানাচ্ছে পূতপবিত্র মসিহের কাছে ছুটে যেতে, কিন্তু সমাজকে আমরা বড়ই ভয় পাই। বোধকরি ফরিসিদের নেতা নিকদিম তাই রাতের আঁধারে মসিহের কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন, ঐশি বিষয় নিয়ে। মসিহ তাকে ‘নতুন জন্মের বিষয় বলেছিলেন, কিন্তু নিকদিমের মতো সুপন্ডিত ব্যক্তির পক্ষেও নতুন জন্মের বিষয় ছিল প্রচ্ছন্ন। মাংস থেকে যা কিছু জাত তা অবশ্যই মাংসিক আর আত্মার দ্বারা যা জন্মলাভ করে অবশ্যই তা আত্মিক।
অবশ্যই আদমের বংশজাত বলে আমরা পাপ ও গুনাহের মধ্যে জীবন-যাপন করে চলছি! চাই আমাদের নতুন জন্ম লাভ, যা একমাত্র খোদার রূহ ও কালাম যা মানুষের রূপে জগতে আগমন করেছেন, আমাদের পাপের কাফফারা পরিশোধ করেছেন, আমাদের মুক্তি দিলেন, কেবল তাঁর মধ্য দিয়েই ঘটেছে আমাদের অনন্ত আজাদি, পিতার সাথে পুনর্মিলনের এক অপূর্ব অভাবিত সুযোগ, যা কেবল খোদার অশেষ রহমতে হয়েছে সাধিত, আমাদের জন্য বিনামুল্যে দত্ত (ইফিষীয় ২ ঃ ৮-১০)।